গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ
ক্ষমতাসীনরা দায়মুক্ত, বিরোধীরা অভিযুক্ত : সরকারের সুদূরপ্রসারী ভীতির প্রতিফলন
প্রকাশ: ১১:৩৬ এএম, ১০ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৫৪ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর সহধর্মিণী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কার্ডিওলজিষ্ট ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের গ্রেফতারি পরোয়ানা ও পরবর্তীতে সম্পত্তি ক্রোকের পরোয়ানা জারির বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরাতন ধারাবাহিক নাটকের নতুন পর্ব হিসেবে মঞ্চায়িত হচ্ছে। ২০০৬-পূববর্তী রাজনীতিতে রাজনীতিবীদদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলার প্রচলন সচারাচর দেখা না গেলেও ২০০৬ সালের পর থেকে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে রাজনীতিবীদদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলার প্রচলন পরিলক্ষিত হয়, যার অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় জিয়া পরিবার।
আন্তর্জাতিক নীলনকশার অংশ হিসেবে বিএনপির চেয়ারপার্সন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো, ভাই সাঈদ ইস্কান্দার, ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক এবং সর্বশেষ তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব শূন্য করার লক্ষ্যেই যে মূলত এই মামলাগুলো করা হয়েছিলো, পরবর্তীতে অনেকবার সেটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিতও হয়েছে। তৎকালীন অরাজনৈতিক সরকার যে শুধু জিয়া পরিবারকেই হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছিলো সেটা কিন্তু না, তারা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রীসহ আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তিবর্গদের নামেও মামলা দিয়েছিলো। আপসকামিতার মাধ্যমে পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন হয়ে নিজেদের মামলা গুলোকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে পরিত্রাণ পেলেও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গুলোকে সচল রেখেছে বিরোধী রাজনীতিবীদদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে, যা ব্যবহার করতে থাকেন ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে।
তারই ধারাবাহিকতায় এই সম্পদ ক্রোকের ফরামায়েশী পরোয়ানা। ক্ষমতার মসনদের স্থায়িত্ব পাকাপোক্ত করতে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্ভাব্য যেসকল প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠান দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। দুদকের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় সাজা প্রদান করে পূর্বেই তারেক রহমান এবং পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়াকে সাজাপ্রাপ্ত করেছে। এমনকি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট ১৯জন প্রার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে অন্যায্যভাবে সফল হয়েছেন।
'আইন সবার জন্য সমান' এটি এখন শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকেই অলংকৃত হয়ে আছে, যার প্রমাণ খোদ দুদক কমিশনই সম্প্রতি দুদকের ১০০০ ব্যক্তিকে 'ক্লিন সার্টিফিকেট' দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তথ্য মতে বিগত দুই বছরে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য, সরকারি সুবিধাভোগী পুলিশ-আমলা, এনবিআর এবং রাজউকের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার এক হাজারের বেশি ব্যক্তিকে অনুসন্ধান পর্যায়ে অব্যাহতি দিয়েছে এই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদের সকলেই সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তি। তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, কমিশন বাণিজ্য এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা বড় বড় অভিযোগ ছিলো।
দুদকে আসা উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মধ্যে তদন্ত শেষে যাদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়েছে তাদের একজন ভোলা-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিলো কমিশন বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন। কিন্তু দুদক তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের কোন 'সত্যতা না পাওয়ায়' জ্যাকবকে অব্যাহতি দেয়। এছাড়া চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিলো কিন্তু প্রমানের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কমিশন।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ১০৬৫টি ফাইল অনুসন্ধান পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়েছে, যার সকলেই সরকারের সুবিধাভোগী কর্তাব্যক্তি। এসব তালিকায় সরকারদলীয় কোটায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নুরুল আনোয়ার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক ডিজি সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক একেএম মমতাজ উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডর সদস্য এস এম হুমায়ূন কবীর, ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী এনামুল হক, যুগ্ম সচিব জালাল আহম্মেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ-কর কমিশনার হুমায়ূন কবীর, বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল বাশার পাটোয়ারি, সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-সচিব দিপংকর রায়, যমুনা অয়েলের জিএম মাসুদ করিম, যমুনা অয়েলের ডিজিএম অর্থ মোহাম্মদ খসরু আজাদ, যমুনা অয়েলের এজিএম অর্থ মোহাম্মদ আবুল বশরসহ প্রমুখ।
অথচ সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তারেক রহমান, জুবাইদা রহমান ও তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় দায়ের করা চক্রান্তমূলক মামলায় অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দায়ের করে ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাপক কর্মদক্ষতা দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দুদকের কর্তাব্যক্তিরা। মামলার অভিযোগ- অপ্রদর্শিত আয়, যা আয়কর দাখিলে উল্লেখ নেই; যার পরিমাণ ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকা, যার সাথে তারেক রহমান অথবা ডা. জুবাইদা রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
সম্প্রতি বিএনপি যখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে গণতন্ত্রকামী দলগুলো এবং আপামর জনসাধারণ নিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই এই অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে জনগণের কাছে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্নীতিবাজ হিসেবে তুলে ধরতে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করেছে ক্ষমতাসীন সরকার।
প্রকৃত অর্থে সরকারি নীতিনির্ধারকেরা দুদকের মিথ্যা প্রহসনের মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা প্রদান করেও স্বস্তিতে নেই। তাদের কাছে অপার সম্ভাবনার অপর নাম তারেক রহমানের ছায়াসঙ্গিনী ডা. জুবাইদা রহমান। যার কারণে আইনি প্রক্রিয়াই ডা. জুবাইদা রহমানকে রাজনীতিতে অযোগ্য করতে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারি সংস্থাগুলো যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ যাত্রায় ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে আগামিতে জিয়া পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মদের চক্রান্তে ফেলার কূট-নকশা অঙ্কিত হবে বলে আমার আশঙ্কা। তবে জিয়া পরিবারের পাহাড়সম জনপ্রিয়তা এই সকল দেশি-বিদেশি চক্রান্ত রুখে দিবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক দল (খুলনা বিভাগ)।