গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ
বায়ান্নোর অঙ্কুরিত বীজের ফসল'ই একাত্তরের স্বাধীনতা : জিয়াউর রহমান
প্রকাশ: ০৩:৪৫ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৫৩ পিএম, ১১ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
শুরুটা কিঞ্চিত শুরু থেকে শুরু করা পাঠকের ইতিহাস রোমন্থন সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ শাসকেরা অনেকটা তড়িঘড়ি করে ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাগজে কলমে ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে ভাগ করতে নিযুক্ত করেন স্যার সিরিল জন র্যাডক্লিফকে। তিনি মাত্র পাঁচ সপ্তাহে কাগজে কলমে সীমানা রেখার মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তানি অংশে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশ সমূহ নিয়ে মানচিত্র প্রদান করেন। যেটি র্যাডক্লিফ লাইন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা রেডক্লিফের অস্বাভাবিক এ ভাগকে র্যাডক্লিফ তথা ইংরেজদের সূক্ষ ষড়যন্ত্র বলে মনে করে থাকেন।
১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারন রেখা প্রকাশ করা হলে, নাটকীয় মোড় নিয়ে শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তানের আন্তঃ ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, পাওয়া- না পাওয়ার অসম সমীকরণ। বন্টনে প্রাপ্ত বাংলা অংশকে প্রথমে পূর্ব বাংলা বলা হলেও পরবর্তীতে ১৯৫৫ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামকরনে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই রেখাটির পশ্চিমভাগ ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত ও পূর্বভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নামে পরিচিত৷
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বন্টিত পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের ধর্ম এক হলেও ভাষার ভিন্নতার কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রস্তাব করেন। শুরু হয় বিপত্তি। পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবি মহল, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে থাকেন। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাংস্কৃতিক সংগঠন 'তমদ্দুন মজলিস' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলনের প্লাটফর্ম তৈরী হয়ে থাকে এবং এই সংগঠনের ব্যানারে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে।
১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার এ দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হলে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন জনসভায় উভয়ই ঘোষণা করেন- 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। সেখান থেকে ভাষা আন্দোলন রুপ নেয় চূড়ান্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে। আগুনে ঘি ঢালার ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আন্দোলনের অগ্নি মশাল।
ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সহ বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে নেমে আসে রাস্তায়,পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে ভেঙে ফেলে ১৪৪ধারা। ক্রমাগত মিছিল সমাবেশ, গুলি, টিয়ার সেল, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নাম জানা এবং না জানা বহু শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিক গনআন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে দাবি আদায়ের স্বীকৃতি অর্জিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদে। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত যার দরুন এটা বাঙালি জাতির সংগ্রামী অনুপ্রেরণার উদ্রেক ঘটিয়েছিলো। পরবর্তীতে, যার প্রতিফলন আছড়ে পরে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের মাঝেও।
জিয়াউর রহমান তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পিতার চাকুরীর সুবাদে থাকতেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। কিশোর বয়সেই তার মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মূল্যবোধ জাগ্রত হয়েছিল, তা তিনি ঐ সময়কার মানসিক যন্ত্রণার অনুভূতি এবং পশ্চিম পাকিস্থানীদের পরাজয়ের ক্ষোভের স্মৃতি রোমন্থন করে তাঁর 'একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে লিখেছিলেন- 'পাকিস্তানী সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম, পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবি, সরকারি কর্মচারি, সেনাবাহিনী, আর জনগণ সবাই সমানভাবে তখন নিন্দা করেছিল বাংলা ভাষার। নিন্দা করেছিল বাঙালিদের।'' তাঁর এ বর্ননায় দশম শ্রেণির একজন ছাত্রের স্বদেশীয় রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে স্পষ্টরুপে এবং তিনি সে সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্ভূদ্ধ হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সফলতা তাকে এমনভাবে অনুপ্রানিত করেছিলো যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করেও পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড অবলোকন করতে থাকেন সচেতনভাবে। তিনি তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছিলেন 'মি.জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে ঠিক সেদিনই বাঙালি হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তানের স্রষ্টা নিজে ঠিক সেদিনই অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজটা বপন করে গিয়েছিলেন এই ঢাকার ময়দানেই।'
জিয়াউর রহমানের এই বর্ননায় স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, তিনি বিশ্বাস করতেন ভাষা আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে কবর রচিত হয়েছিল পাকিস্তানিদের এবং ভাষা আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ, যার ফসল পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রাম। তিনি পরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের বিজয় সহ বাঙালির সকল সফলতার পেছনে ভাষা আন্দোলনের সফলতার অনুপ্রেরণা গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করতেন এবং তিনি ঐ দিনই বাঙলার আকাশে মুক্তির আলোক বর্নিল রেখার অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যার কারণে তিনি সাহসী হয়ে উঠেছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সহপাঠীদের সাথে স্বদেশের পক্ষে প্রায়শই বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন সাথে সাথে নিজ মনে আকাঙ্ক্ষা লালন করতেন যদি কখনো দিন আসে তবে তিনি পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বে আঘাত করবেন। যে আকাঙ্খা তিনি সযত্নে লালন করতেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে তরান্বিত করেছিল ভাষা আন্দোলনের সফলতা যা তাঁর বিজয়ের উল্লাস প্রকাশের মুহূর্তের বর্ননায় ফুটে উঠেছিলো। তিনি যুক্তফ্রন্টের এ জয়কে বাংলা ভাষার জয় হিসেবেও মূল্যায়িত করেছিলেন তাঁর লেখায়। তাঁর এই মনোবল পরবর্তীতে স্বাধীনতার সম্মুখযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার দুঃসাহস ও মনোবল যুগিয়েছিল। তিনি ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করতেন এবং তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ চলকালীন সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার আহবান জানিয়ে সংগঠিত করেছিলেন।
স্বাধীনতার পরে দেশের প্রয়োজনে তিনি যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ অম্লান ও স্মরণীয় করার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি স্মারক হিসেবে রাষ্ট্রের জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার 'একুশে পদক' প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানকারী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৬ সাল থেকে একুশে পদক প্রদান শুরু করে থাকেন।
জিয়াউর রহমান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রথমবারের মতো একুশে পদক প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও বেগম সুফিয়া কামাল একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। একুশকে যে তিনি মনেপ্রাণে লালন করতেন যা তাঁর গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাঝেই স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয়েছে। তিনি ভাষা শহীদের পরিবারেও পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার সময়কালে। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের আইনগত দিকগুলোও তার আমলে যাচাই-বাছাই ও সমৃদ্ধ হয়েছে যার ধারবাহিকতায় সেটা পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে আইন রুপে গৃহিত হয়েছিলো।
একুশের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও তিনি মনে প্রাণে লালন করতেন। যার কারণে পরিবেশ পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী বাঙালি জাতীয়তাবাদ কে নিরুৎসাহিত না করে একে আরও দৃঢ়ভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক সর্ববৃহৎ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সার্বিক উন্নয়ন ও এর কাঠামোগত বিকাশ সাধনে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ৬ জুন ‘দি বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮’ জারি করেছিলেন। বাংলা একাডেমির পরিচালনায় এ অধ্যাদেশটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বাংলার নব জাগরণে, বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সর্বোপরি বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ও ভবিষ্যতে রাখবে যা জিয়াউর রহমান সবসময় মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন।
তথ্য সূত্রঃ তারেক রহমান সম্পাদিত 'জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক' গ্রন্থ, জাতীয় দৈনিক পএিকা, উইকিপিডিয়া।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।