গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ
বাংলাদেশে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে তারেক রহমানের ভাবনায় ইংল্যান্ডের NHS মডেল
প্রকাশ: ০২:৪৮ পিএম, ১০ এপ্রিল,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:১৫ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম অধিকার চিকিৎসা। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশে এই নাগরিক অধিকার চিকিৎসা সেবার যে টালমাটাল ও জগাখিচুরি অবস্থা তা বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস আঘাতের সময়কালে এদেশের সাধারণ জনগন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। বৈষম্যময় স্বাস্থ্যসেবার কারণে সাধারণ মানুষ নুন্যতম সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে হাসপাতাল বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন।
স্বাস্থ্যসেবার মানহীন অবস্থার কারণে শত শত সুবিধাবঞ্চিত নাগরিক মৃত্যুকে বরণ করেছেন তা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সকলেরই জানা। গত ৭ই এপ্রিল, ২০২২ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনাসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের বক্তব্যে তিনি বলেন, "আগামী দিনে জাতীয়তাবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে বাংলাদেশে ইংল্যান্ডের NHS এর আদলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা কমিশন গড়ে তোলা হবে।" বিষয়টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও অগ্রসর মানষিকতার বহিঃপ্রকাশ।
ইংল্যান্ডের NHS বিষয়টি কি? এবং কি কারণে তিনি এটিকে মডেল হিসেবে তুলে ধরেছেন সে বিষয়টি সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব তুলে ধরা হলো। শুরুতে ইংল্যান্ডের NHS বিষয়টি আসলে কি? এবং সংস্থাটি কিভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। National Health Service in UK (NHS) প্রথমে ১৯৪৪ সালে প্রাথমিকভাবে এবং পরবর্তীতে ১৯৪৮সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ইংল্যান্ডের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দোড়গোঁড়ায় পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে এর যাত্রা শুরু হয়। NHS ইংল্যান্ড হলো একপ্রকার ছাতা সংস্থা যা ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম তদারকি ও তত্ত্বাবধান করে থাকে। ইহা একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যার নিজস্ব নীতি, কর্ম পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে এবং রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরাসরি এর কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করার কোন প্রকার এখতিয়ার রাখেনা। CCGs(Clinical Commmissiong Groups) এর একটি কার্যকরী নীতিমালা ও কাঠামো আছে যা Health and Social care act uk 2012 অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। আইন অনুযায়ী সহায়তা প্রদান অথবা সম্পাদনা নিশ্চিত করা সংস্থাটির কার্যত দায়িত্ব। সাধারণ জনগণের কর ও জাতীয় বীমা খাত থেকে সংস্থাটি অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে।
স্বাস্থ্যসেবাকে এক ছাতার নিচে বৈষম্যহীনভাবে প্রদান করে সংস্থাটি। ব্যাপক আকারে, সর্বজনীনভাবে ও বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাই হলো সংস্থাটির অন্যতম মূলনীতি। যেখানে অর্থ প্রদানের সক্ষমতা বিবেচনায় না নিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। NHS একটা সুবিন্যস্ত সেবা সংস্থা যেখানে ইংরেজি বর্ণমালা A to Z ক্রমানুসারে রোগের আদ্যক্ষর দ্বারা সুবিন্যস্ত এবং সেবাপ্রার্থীর রোগের আদ্যক্ষর দ্বারা সেবা সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে এবং পরামর্শ ও করনীয় গ্রহণ করতে পারেন। NHS প্রদত্ত সেবা সমূহ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। সাধারণত General Practician service (GPs) দ্বারা বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্বশীল ডাক্তার সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য, ডাক্তারের পরামর্শের/সাক্ষাতের সময় নির্ধারন, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র প্রদান, প্রয়োজনীয় ঔষধ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে সংস্থাটি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সহ বিশেষায়িত হাসপাতাল নিশ্চিত করা ও যথাযথ চিকিৎসার প্রয়োজন অনুযায়ী হাসপাতাল পরিবর্তনে সহায়তা প্রদান করে থাকে। রোগীর জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা, ইংল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের আশেপাশের সেবা আগ্রহীদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রেখে থাকে, জরুরি সেবা প্রদান, যৌন স্বাস্থ্য সেবা, ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসার ব্যয়ভার সম্পর্কে তথ্য প্রদান, দন্ত্য চিকিৎসা, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও বিনামূল্যে চোখের রোগ নির্নয়, মাদক নিরাময়ে পূর্নবাসন সেবা, সশস্ত্র বাহিনীর ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা, অনলাইনে কাউন্সিলিং সেবা, লিঙ্গ ডিসফোরিয়া সেবা, ছাত্র ছাত্রীদের স্বাস্থ্য সেবা সহ অনেক প্রকার জটিল স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করে থাকে সংস্থাটি। জনসাধারণের প্রয়োজনে একটা নিদিষ্ট সর্বজনীন নম্বরের মাধ্যমে, নিবন্ধিত অ্যাপের মাধ্যমে এবং স্বশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে সংস্থাটি সেবা সমূহ প্রদান করে থাকে। একজন ভুক্তভোগী বা সেবাপ্রার্থী ইংল্যান্ডের যেকোনো স্থান থেকে একটা জাতীয় সেবা নম্বরে একটা ফোন কলের মাধ্যমে NHS এর পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারেন। ইংল্যান্ডের ১৩বছর ও পরবর্তী বয়সের মানুষেরা অ্যাপে তথ্য নিবন্ধনের মাধ্যমে NHS সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে সংস্থাটি। এছাড়াও নাগরিকদের কোভিড প্রতিকারে টিকা/ভ্যাক্সিন, নবজাতকের টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে জনগণকে সুশৃঙ্খলভাবে ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনতে সহযোগিতা প্রদান করে সংস্থাটি। মার্চ ২০২১ এর সমীক্ষা মোতাবেক ১,২৪,০৭৮ জন ডাক্তার ও ৩,০৪,৫৪২ জন নার্স NHS এর তত্ত্বাবধানে সংস্থাটি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সংস্থাটি একটা নিজস্ব সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের সকল নাগরিকের জন্য NHS এর বিনামূল্যে সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে যে অধিকার ইংল্যান্ডের সংসদ দ্বারা সুরক্ষিত। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া সংস্থাটি বিশ্বের রোল মডেল এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
অধিক জনসংখ্যার এদেশে শুরুতেই ১০০% চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে NHS এর আদলে স্বাস্থ্যসেবা চালু করলে সাধারণ নাগরিকেরা অঞ্চল ভিত্তিক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারবে। যার দরুন সেবা গ্রহণের জটিলতা এবং দালাল চক্রের দৌড়ত্ব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। অতি অল্প সময়ে অ্যাপস অথবা জরুরি হেল্পলাইন নম্বর ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বিনামূল্যে পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ এবং দ্রুত সময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবে। অঞ্চল ভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবা যখন নিশ্চিত করা যাবে তখন রাজধানী কেন্দ্রিক চিকিৎসা সেবাপ্রাপ্তিদের চাপ ও ক্রমন্বায়ে হ্রাস পাবে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত স্বাস্থ্য সেবা খাতটি হয়তো রাতারাতি আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হবে না, তবে যখন প্রত্যেকটি নাগরিককে এই আধুনিক সেবা গ্রহণ ও ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন সবাইকে একটা ছাতার ছায়াতলে নিয়ে আসা যাবে। নিষ্টাবান, দায়িত্বশীল, জবাদিহি পরিচালনা পর্ষদের দ্বারা স্বাধীনভাবে পরিচালনা যখন নিশ্চিত করা যাবে তখন জনগণ কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির অধিকার ফিরে পাবে। দক্ষ, মানবিক ও প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনীর কর্মসংস্থানের সাথে সাথে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সদিচ্ছা, সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্রনয়ণে ইংল্যান্ডের NHS আদলে স্বাস্থ্য সেবা কমিশন গঠনের ভাবনা বাস্তবায়নযোগ্য। সুস্থ জাতিই পারে সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।