গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ
মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর : তাজউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ০৪:৩২ পিএম, ২৬ মার্চ,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২০ এএম, ১৮ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
অনেক পূর্বের ইতিহাস জানা নেই তবে সমসাময়িক যুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘটনা ছিলো বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী। তার অন্যতম কারণ যুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধের রাজনৈতিক সেনাপতি বন্দীত্ব লাভ করেন এবং যুদ্ধে সে দেশ বিজয়লাভ করে। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও বাস্তব, ইতিহাসে এমন ঘটনা পূর্বে ঘটেছিলো কিনা তা আমার জানা নেই।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হেরাল্ড পত্রিকার বরাতে জানা যায়, ২৫ মার্চ আনুমানিক ১লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিলো। অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী নেতাদের নুন্যতম কোন প্রস্তুতি যে ছিলো না তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এবং তারা তখনও রাষ্ট্রদ্রোহী হতে প্রস্তুত ছিলেন না। 'বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাতকাহন' গ্রন্থে ড. মোঃ মকসুদুর রহমান ২৫শে মার্চের দিনের বর্ননায় উল্লেখ করেন "২৫তারিখ বিকেলে একটা বৈঠক হবে বলে ধারণা করা হয়, সে কারণে বঙ্গবন্ধু বাসায় স্বাভাবিকভাবে অবস্থান করেন। সেদিন শেখ কামালকে (মুজিব পুত্র) বায়তুল মোকাররমে নির্ভয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে পীরজাদার টেলিফোনের অপেক্ষায় ড.কামাল হোসনকে দেখা যায়।"
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিকল্পনাহীনতা ও সময়পোযোগী দিকনির্দেশনার অভাবে সাধারণ বাঙালি যখন দিশেহারা ছিলো ঠিক তখনই পশ্চিম পাকিস্তানের উন্মাদ প্রভুদের শোষনের সময়কে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ থেকে মুক্তিকামী সাধারণ ও বুদ্ধিজীবি নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর 'অপারেশন সার্চ লাইট'-এর নামে যে বর্বর লোমহর্ষকার নির্যাতন নেমে এসেছিল সেটা আগে থেকেই আচঁ করতে পেরেছিলেন তৎকালীন সচেতন বাঙালিরা, শুধু পারেননি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা। যুদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী সেটা যদি তারা আঁচ করতেই পারতেন তবে যুদ্ধের কৌশল অথবা পরিকল্পনা তাদের থাকতো। যদিও ইতিহাস তেমনটা সাক্ষ্য দেয়না, আর যদি তারা আচঁ করতেই না পেরে থাকেন তবে তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট চিত্রায়ণে তৎকালীন রাজনীতিবিদদের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য ছিলো সেটা সর্বজনসিদ্ধ। যেহেতু আলোচনার বিষয়বস্তু ইতিহাস নির্ভর এবং অকাট্য সেহেতু দালিলিক নির্ভরতা লেখনীতে উৎসাহব্যঞ্জক।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক। ১৭ এপ্রিলে এ দায়িত্ব অর্পিত হয় বাংলাদেশের আরেক সূর্যসন্তান আতাউল গনি ওসমানীর ওপর। ১১ এপ্রিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন : ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে।’
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১১ এপ্রিলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যা বলেছিলেন তাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর।’ একই বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর’ “স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ২য় খন্ড)। এই কণ্ঠস্বর যে মেজর জিয়াউর রহমানের সেটা প্রমাণিত।
স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক, সাহিত্যিক ব্যক্তিবর্গ যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ওতোপ্রোতোভাবে ভূমিকা রেখেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের উদ্ধৃতি আলোচনার বিষয়বস্তুর অকট্যতা প্রমানে পাঠকের প্রয়োজনে তুলে ধরা হলো।
মেজর রফিক-উল ইসলাম বীরউত্তম, মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) তার লেখা গ্রন্থে লিখেছেন : ‘২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দান করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কেন তিনি মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যা ও দিয়েছেন মেজর রফিক-উল ইসলাম। একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা দিলে এই ‘আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র’ (Political Character of the Movement) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থান সামরিক অভ্যুত্থান রূপে চিত্রিত হতে পারে, এই আশঙ্কায় দেশপ্রেমিক মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ঘোষণা দিলেন। তা শ্রুত হয় ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত (Rafiq-ul-Islam, A Tale of Millions, Dhaka. BBI, 1981)। মেজর রফিক বর্তমানে জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত সদস্য। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রূপে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম পরবর্তীতে আওয়ামী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী তাঁর গ্রন্থে—Bangladesh At War (Dhaka, Academic publishers, 1989) ৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন তা উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন : মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে, পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান করেন। এই ঘোষণায় তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন।
২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন : ‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়ক রূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ [ `Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the Independence of Bangladesh' ]। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিড়াল-কুকুরের মতো মরবো না, বরং বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান রূপে (স্বাধীনতার জন্যে) প্রাণ দেব। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সমগ্র পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোহর, বরিশাল, খুলনায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘিরে ফেলেছে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।’ মেজর সফিউল্লাহর অভিব্যক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তার মতে, এই ঘোষণা দেশে এবং বিদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে। যারা ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধে রত ছিলেন এই ঘোষণা তাদের নৈতিক বল ও সাহসকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যরাও এই যুদ্ধে শামিল হন।
মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া, মেজর জেনারেল (অব.) তার লিখিত—মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস গ্রন্থের ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠায় (ঢাকা, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৭২) লিখেছেন, ‘মেজর জিয়াকে ২৭ মার্চের সন্ধ্যায় দেখে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ফেটে পড়ল বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা। ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি তৈরি করে নিজেই সেটি ইংরেজি ও বাংলায় পাঠ করেন। মেজর জিয়া ওই ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার পরের দিন আগের দেয়া বেতার ভাষণটির সংশোধন করে তিনি ঘোষণা দেন যে এই মুক্তিযুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে।
মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মেজর জিয়ার সেই বক্তৃতা শুনে নিজের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে বলেন, ‘মেজর জিয়ার ঐ উদ্দীপনাময় নেতৃত্ব আমাকে সংগ্রামের কাজে আরও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। তখন থেকেই তাঁর নির্দেশে আমি কাজ করে যাই।’
কর্নেল অলি আহমদ, বীরবিক্রম, অক্সফোর্ড বুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের অনুবাদ গ্রন্থে-রাষ্ট্র বিপ্লব : সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা, অন্বেষা প্রকাশন, ২০০৮) আরো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মেজর জিয়া ২৭ মার্চ ১৯৭১ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া ছিলেন আমাদের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’ (মুখবন্ধ)। অলি আহমদ তখন ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন। সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার সময় তিনি মেজর জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন।কর্নেল অলি আহমদ তার অভিসন্দর্ভ রচনার জন্যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন ৮ জন শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তার। তাদের সবাই বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে জিয়াউর রহমান প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা তারা শুনেছেন। সেক্টর নম্বর ৫-এর কমান্ডার তৎকালীন মেজর এবং পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী, বীরউত্তম বলেন, অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি (পৃষ্ঠা ১৬৬, ১৬৭, ১৭১)। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার (১৫ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন : ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে মেজর জিয়ার সদলবলে বিদ্রোহ এবং ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক কর্মকর্তারাই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ১০ এপ্রিলে স্বাধীনতার সনদ রচনা এবং ১৭ এপ্রিলে মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠিত হলে রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নাম ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তখন থেকে সামরিক কর্মকর্তারাও বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে এবং তাদের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারাই কিন্তু দীর্ঘ তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখেন।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের ভাবনাচিন্তাও ছিল এমনি। তাঁরাও একপর্যায়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও বাংলার দামাল ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এমনি একজন সুখান্ত সিং। মেজর জেনারেল হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর The Liberation of Bangladesh, Vol. 1 (Delhi : Lancer Publishers, 1980) গ্রন্থের ৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে একজন বাঙালি অফিসার মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।’ তিনি আরো লেখেন : ‘এই ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি সেনা অফিসারগণ রাজনীতিক নেতাদের অসন্তুষ্ট করতে চাননি। অন্যদিকে ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবার আবশ্যকতা ছিল।’ শুধু তিনি কেন, ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরে ভারতের রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যে বক্তব্য প্রদান করেন, তাও উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রপতি রেড্ডি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আপনার দেশের ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণাকারী ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার সমুজ্জ্বল অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গেছে।’ [মুহম্মদ শামসুল হক, (Bangladesh in International Politics, Dhaka, UPL, 1993, P-96]।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে অন্যতম উল্লেখযোগ্য নায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফ আর জ্যাকব (JFR Jacob)। তিনি তার Surrender At DACCA : Birth of a Nation, (Dhaka, UPL, 1997) বই এর ৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘চট্টগ্রামের আট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মেজর জিয়াউর রহমান রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বেতার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন। সেই ঘোষণা অনেকেই শুনেছেন। যারা নিজ কানে শোনেননি তারাও মুখে মুখে চারদিকে প্রচার করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘মেজর জিয়া বাঙালি রেগুলার ও আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সহায়তায় চট্টগ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন’ (পৃষ্ঠা ৩৫)। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম ডেপুটি হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিত, যিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তার লেখা গ্রন্থের Liberation And Beyond : Indo-Bangladesh Relations, (Dhaka, UPL, 1999) ৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান (যিনি ১৯৭৬-৭৭ সময়কালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) স্বল্পকালীন পরিসরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং সেই কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দান করেন। সেই ঘোষণায় তিনি বাংলার সকল সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের আহ্বান জানান।’ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার আগে রেকর্ড করা তাঁর ঘোষণার পূর্বেই জিয়াউর রহমানের ঘোষণা প্রচারিত হয় ("In fact, Ziaur Rahman's broadcast came a little earlier than Mujib's broadcast."-Ibid)।
অরাজনৈতিক এবং নিরপেক্ষ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে তাঁর জনপ্রিয় জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসে লিখেছেন " ২৭শে মার্চ শনিবার রাত আঁটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় ... মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন - ''আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি" তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন ।
দেশের মানুষের ভিতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয় ... তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদণ্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায় ... তাদের চোখ ঝলমল করতে থাকে । একজন অচেনা অজানা লোকের কণ্ঠস্বর এতটা উম্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না ।"
১৯৭১ সালের ৬ই নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত একটা বক্তৃতায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক এবং সমাজের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে স্পষ্ট করে বলেছিলেন : ‘স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিব গ্রেফতার হবার পরে, তার পূর্বে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।’ ["The cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for independence even now."]।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সাইরেন রুপে মানুষের হৃৎপিন্ডের রক্ত প্রবাহকে তরান্বিত করেছিলো এবং যার আঘাতে দিশেহারা বাঙালি জাতির মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে যুগিয়েছিল অসীম সাহস ও করেছিলো দৃঢ় প্রত্যয়ী।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।