অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
একজন পিতার মৃত্যু এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াই
প্রকাশ: ০৫:১৪ পিএম, ৯ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১১:২২ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যখন শহীদের তালিকা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে তখন একটি সংবাদ আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যুবদলের একজন নেতার বাসায় আক্রমণ করে বৃদ্ধ পিতাকে মারাত্মক আহত করে যার ফলশ্রুতিতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই ঘৃণ্য ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে বারোটায় ওয়ারী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ফয়সল মেহবুবের গৃহে। পরিবারের বর্ণনায় একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী জোরপূর্বক তাদের গৃহে প্রবেশ করে ফয়সলকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে তার চাচা শাহাদত হোসেনকে মারতে মারতে নিচে নামাতে থাকে। তখন ফয়সলের পিতা তাদের বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীরা উনাকে আহত করে। উনি মাথার পিছনে মারাত্মক আঘাতে মারা যান।
ফয়সলের পিতার নাম মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেন যার বয়স ছিল ৬৭ বছর। জীবনযুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে টিকে থাকা একজন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধের মৃত্যু হয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে। সৈরাচারী সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশের কাছ থেকে দায়সারা ফিরিস্তি পাওয়া যায়। ওয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবির হোসেনের ভাষ্যমতে, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা ফয়সলকে খুঁজতে তাদের বাসায় গেলে ফয়সলের পিতা স্ট্রোক করে পড়ে যান এবং মাথায় আঘাত পেয়ে তার মৃত্যু হয়। ফয়সলকে না পেয়ে তাঁর চাচা শাহাদত হোসেনকে আটক করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা ওয়ারী ফাঁড়িতে নিয়ে যায় এবং বুধবারের নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় শাহাদত হোসেনের জড়িত থাকার দাবি করে। ওয়ারী ফাঁড়ির পুলিশ শাহাদত হোসেনকে থানায় সোপর্দ করে। থানা পুলিশ পরে তাকে ছেড়ে দেয়।
এ ঘটনায় আমরা জানতে পারলাম আমাদের পুলিশ বাহিনীতে এখন প্রতিভার ছড়াছড়ি। ওয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শীতায় পিতা মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেনের মৃত্যু রহস্য ভেদ করা গেছে। তা একটা বিষয় জানতে পারলে আরও ভালো হতো। উনি কাদের সাথে কথা বলে পিতা মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেনের লুটিয়ে পড়ার বর্ণনা জেনেছিলেন। পরিবারতো বলছে ভিন্ন কথা। তাহলে তিনি কি ’অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি’-দের সাথে কথা বলেছিলেন, যাদের নাম, ঠিকানা অথবা রাজনৈতিক পরিচয় কিছুই জানেন না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে নিজের কাজের বিষয়ে যদি একটু পটু হতেন। জোরপূর্বক গৃহে প্রবেশ, মারধর, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া-কতগুলো অপরাধ সংঘটিত হলো। যেখানে মৃত ব্যক্তি মামলার আসামি হয়ে যায়, তখন নাকের ডগাতে এতগুলো অপরাধ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা স্বাচ্ছন্দ্যে করে চলে গেলো? নাকি সরকারি দলের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া এখন পুলিশের কাজ?
বর্তমানের আপাদ-মস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, খুনি, লুটেরা, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী অবৈধ স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কৃত অপকর্মসমূহ ইতোমধ্যেই আইয়ুব খান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অতিক্রম করেছে। আর এজন্যই মরণ কামড়। অপরাধের ব্যাপকতা এবং নৃশংসতা সকল মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সংস্থা গঠনে পরামর্শ দিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। দেশের মানুষের জীবন ধারণ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে, ব্যাংকগুলো সরকারদলীয় চোরদের পাল্লায় পড়ে দেউলিয়ার পথে, রিজার্ভের ডলার চুরির হদিস আস্তে আস্তে বের হচ্ছে, দেশের জনগণ ‘সোনার ছেলেদের’ কাছে জিম্মি। আর এর মধ্যে গণতন্ত্র উদ্ধারের শান্তিপূর্ণ বৈধ আন্দোলন নিস্তব্ধ করতে এ অবৈধ সরকার রক্তের খেলায় মেতে উঠেছে।
খুনে র্যাব এবং তাদের কিছু দুর্বৃত্ত কর্মকর্তা আন্দোলন দমাতে ব্যাপকভাবে মানবতা বিরোধী অপরাধের মাধ্যমে সারাবিশ্বে এখন নিন্দিত। মানবধিকার দিবস এবং আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে এখন বাংলাদেশের ঘটনাবলীু আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়। এ অবস্থায় স্বৈরাচারী সরকার তাদের দলীয় সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়েছে। আর তাদের অপরাধের আলামত ধ্বংসের দায়িত্ব জনগণের করের টাকাতে পরিচালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। অথচ আন্দোলনের দাবি ন্যায্য-ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা। এই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষ মরণপন সংগ্রাম করেছে-ঊনসত্তর এবং নব্বই-এ। স্বৈরাচারদের পরিণতি আমরা দেখেছি। আর স্বৈরাচার যখন দানব হয়ে যায় তার দুঃখজনক বিদায়ের উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা।
মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেনের মত অগণিত পিতা বুকে পাথর বেঁধে তাদের সন্তানদের গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন কোনো না কোনো পিতা তার শহীদ সন্তানের লাশ কবরে নামাচ্ছেন। অনেক পিতা অশ্রুসজল চোখে তার নিখোঁজ স্নেহময়ী সন্তানকে তালাশ করছেন। আর আজকে আমরা একজন পিতার লাশ কবরে নামাব। এই পিতার লাশের শপথ, আমাদের প্রতিটা ভাই-এর রক্তের বদলা বিন্দু বিন্দু করে বুঝে নেওয়া হবে। আর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ হবে নির্মম। আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ঘরে ফিরব, তার আগে না।
লেখক : শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)