অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে সন্দেহ, দায় কার?
প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ৭ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৪৭ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত? অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ এ প্রশ্নের এক লাইনের উত্তর থাকা উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি সূত্র থেকে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর পাই নাতিদীর্ঘ কৈফিয়তের আদলে। প্রথমদিকে সাধারণ জনগণ কৌতূহল নিয়ে সংবাদসমূহে চোখ রাখত। তারপর যখন তেল- গ্যাস আমদানির ব্যর্থতায় দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিল তখন তারা আরো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা শুরু করে। ততোদিনে আইএমএফের বদৌলতে জানতে শুরু করেছে যে সরকার রিজার্ভ-এর পরিমাণ যা বলে, প্রকৃত রিজার্ভ তার চেয়ে বেশ কম। কৌতূহল তখন পরিণত হলো বিভ্রান্তিতে, কারণ কোনো সূত্রে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। আর এ বিভ্রান্তি সন্দেহে পরিণত হয় যখন নভেম্বর মাসে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক আমদানি ঋণপত্র খোলা বন্ধ করে দেয়। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা হওয়ার কথা না। সমস্যাসমূহ কিন্তু ঘুরে ফিরে একই জায়গায়। স্বেচ্ছাচারী সরকার, মত প্রকাশে বাধা, ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি এবং দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ হিসাবের পদ্ধতিতে আইএমএফ তাদের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে প্রায় এক বছর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত রিজার্ভের পরিমাণে তারা দ্বিমত জ্ঞাপন করে এবং হিসাব করে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে অতিরিক্ত ৭২৬ কোটি ডলার বেশি প্রদর্শন করছে। তারা হিসাব করে বলে দেয় কি কি বাদ দিতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ হিসাব করতে আইএমএফ-এর Balance of Payment and International Investment Position (BPM-6) ম্যানুয়াল অনুসরণ করতে সুপারিশ করে। অধিকাংশ দেশ সর্বমহলে স্বীকৃত এই ম্যানুয়াল অনুসরণ করে। তখনকার হিসাবে আইএমএফ রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে বলে দেশের ব্যাংক মূহকে দেওয়া ৬১৯ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ (যা এখন বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০-এর কাছাকাছি), বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত সরকারি ব্যাংকসমূহের ৬৫ কোটি ডলার, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছে জমা থাকা ২৮ কোটি ডলার এবং বিভিন্ন বিনিয়োগে ৬ কোটি ডলার। এর সাথে তারা শ্রীলংকাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলারের ঋণ-এর জামানত হিসাবে প্রাপ্ত ৪,৯০০ কোটি রুপি হিসাবের বাইরে রাখতে বলে। তদুপরি ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেটের বিষয়ে আপত্তি জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ-এর সুপারিশ মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এই বছরের জুলাই পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অটল ছিল। আর এখানেই বিভ্রান্তির সূত্রপাত। এর পর যখন দ্রুত পতনশীর ডলার রিজার্ভে বিচলিত হয়ে সরকার ঋণ সহায়তার জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয় তখন বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক নিয়মে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশে নীমরাজি হয়। আর গত নভেম্বরে তা সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে বাস্তবায়নে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য মতে, আইএমএফের সুপারিশ মেনে চলা থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা জরুরি। এই সেই বাংলাদেশ ব্যাংক- যারা ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনা এক মাসের বেশি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। আজ পর্যন্ত খোয়া যাওয়া ৬.৬ কোটি ডলার উদ্ধার করতে পারেনি। তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিআইডির প্রতিবেদন দাখিল ৬০ বার পিছিয়েছে। আর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, নিউইউর্ক-এর ফেডারেল কোর্ট বাংলাদেশের দায়ের করা চুরি যাওয়া ডলার উদ্ধারের মামলা খারিজ করে দিয়েছে, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। আর দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাকের ডগা দিয়ে গা শিউরে উঠার মতো নির্দ্বিধায় সুসংবদ্ধভাবে ব্যাংক লুট করেছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক কার অথবা কাদের স্বার্থ রক্ষাতে সচেষ্ট তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
আসলেই বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের স্বার্থ রক্ষা করলো? আইএমএফের সাথে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবের আলোচনার মধ্যেই রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের পরিমাণ ২০২২-এর মার্চে ৬০০ কোটি ডলার থেকে ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত করে আরও ডলার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে যেখানে এই তহবিলের অপব্যবহারে গুরুতর অভিযোগ ছিল। এমনকি ঋণের সুদ তিন ধাপ বাড়ানোর পরও বর্তমানে ৪% যা ৬ মাসের গড় LIBOR ( London Inter Bank Offer Rate) থেকে ১% কম। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাক ট-ু ব্যাক ঋণপত্র-এর বিপরীতে (কিছু অনুমোদিত বাল্ক ক্রয় ব্যতীত) রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ডলার ঋণ বিতরণ করার কথা। রপ্তানি সম্পন্ন হলে অর্জিত ডলারে এককালীন পরিশোধে ঋণ সমন্বয় হওয়ার কথা ঋণ গ্রহনের ১৮০ দিনের মধ্যে, যা আবার সেপ্টেম্বরে ৯০ দিন বাড়নো হয় এবং তিন কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি একটা বড় অংশ অনাদায়ী এবং তার বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে বাধ্যতামূলক টাকার হিসাবে ঋণ খোলা হয়েছে। এমনকি এর মধ্যেই রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ খেলাপিদের নতুন করে আবার ডলারে ঋণ দেওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ১৯ এবং ২৯ জুলাই ব্যাংকসমূহকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে। আশ্চর্যের বিষয় মোট কত পরিমাণের লোন অনাদায়ী এবং তার বিপরীতে বাধ্যতামূলক টাকার হিসাবে ঋণ খোলা হয়েছে তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট নেই। শুধুমাত্র সরকারি চারটি ব্যাংকের হিসাবে এর পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা, যা ডলারে ৮০ কোটি। ঘটনা তাহলে কি ঘটেছে? ব্যাপক পরিমাণে রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে, নাকি আয়োজন করে ডলার চুরি করা হয়েছে? বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ খেলাপির যেরকম উৎসব আমরা দেখি তাতে ডলার চুরির সন্দেহ অমূলক নয়।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে ডলার প্রদান করে। চুক্তি অনুযায়ী ঋণের মেয়াদ পূর্তিতে অনাদায়ী থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত থাকা ডলার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্তন করতে পারে। এখানে প্রশ্ন থাকে, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের এ পরিমাণে ডলার গচ্ছিত আছে কি না? ২০২১ সালের আইএমএফের সুবাদে আমরা জেনেছিলাম সরকারি ব্যাংকসমূহের গচ্ছিতের পরিমাণ মাত্র ৬৫ কোটি, যা তাদের অনাদায়ী ৮০ কোটির থেকে কম। খুব সম্ভবত এই গচ্ছিতের পরিমাণ বর্তমানে ভয়াবহ রকমের কম। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আমদানি দায় মেটাচ্ছে, যার সিংহভাগ সরকারি ব্যাংকের ক্রয়। কিছু ব্যাংক তাও পারছে না। এর অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক এখন চাইলেও সহসা অনাদায়ী রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ সমন্বয় করতে পারছে না।
এখন দেখা যাক শ্রীলংকাকে ২০২১-এ দেওয়া ২০ কোটি ডলারের ঋণ। শ্রীলংকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ২০২১-এর মার্চে মুজিব জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল এই লোন একটি বন্ধু রাষ্ট্রকে বিপদে সহায়তা করার জন্য, বণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। আবার সাথে এই হিসাবও দেখানো হয়েছিল, ঋণের সুদ যেকোন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের চেয়ে লাভজনক। তারপর দ্রুততার সাথে তিন কিস্তিতে ২০ কোটি ডলারের ঋণ আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২১ দুই মাসে প্রদান করা হয়। তিন মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ শুরুর কথা থাকলেও বাস্তবতা হলো বর্তমানে এই ঋণের জামানত হিসাবে ৪,৯৫০ কোটি শ্রীলংকান মুদ্রা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিছুই নেই। ঋণ পরিশোধে তিন দফা সময় বর্ধিত করে সময়সীমা এখন জানুয়ারি ২০২৩। শ্রীলংকাকে লোন দেওয়ার সময় তাদের ডলার রিজার্ভ ছিল ২৪০ কোটি টাকা, এখন তা কমে হয়েছে ১৬০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানালেন, তার সাথে শ্রিলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের কথা হয়েছে এবং তিনি কথা দিয়েছেন মার্চ ২০২৩-এর মধ্যে ২০ কোটি ডলার ফেরত দিবেন। দুই সূত্র থেকে দ্ইু ধরনের তথ্য এসেছে-আরেক সূত্র বলছে গভর্নর বলেছেন মার্চ ২০২৩ থেকে কিস্তি পাওয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ঝানু আমলা, তাই নিজের বক্তব্যের ওজর আগেই তৈরি করে রেখেছেন অথবা এটি আমাদের সাংবাদিক ভাইদের ভুল পরিবেশন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কিস্তি শুরুটা বাস্তবসম্মত এবং এ লোন শোধে শ্রিলংকা ১০ থেকে ১২ বছর সময় নিবে। উল্লেখ্য, শ্রীলংকার আন্তর্জাতিক ঋণের পরিমাণ প্রায় কম বেশি ৫,০০০ কোটি ডলার।
সংকট এতটাই প্রকট বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমনেচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের ডলার একাউন্ট খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। ডলার আয় বৃদ্ধি এবং পাচার বন্ধ করার শক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে ব্যয় সংকোচনের পন্থা অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন করবে এবং বেকারত্বের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। তার উপর আমাদের সামনের বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক ঋণ শোধের পরিমাণ বাড়ছে। শ্রীলংকা ২০২০ সাল থেকে ব্যয় সংকোচনের নীতি অনুসরণ করে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সারের অভাবে কৃষি উৎপাদন ২০% কমে তাদের খাদ্য ঘাটতি ঘটেছে |
রিজার্ভ থেকে বাদ পড়ার খাতে সাম্প্রতিক হিসাবে আরও আছে ২০ কোটি ডলারের গ্রীন ট্রান্সফরমেশন তহবিল, ৮৮ কোটি ডলারের বিমানের উড়োজাহাজ কেনার ঋণ গ্যারান্টি এবং ৭.৭ কোটি ইউরো/ ডলারের পায়রাবন্দরকে দেওয়া ঋণ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছে জমা থাকা ২৮ কোটি ডলার এবং বিভিন্ন বিনিয়োগে ৬ কোটি ডলার। গ্রীন ট্রান্সফরমেশন তহবিলের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে লোন দেওয়া হয়েছিল। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে ডলার পাচার এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। ৪৮ কোটি টাকার বিমানের উড়োজাহাজ কেনার ঋণ গ্যারান্টি কোনোদিন ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ কারণ দুর্নীতিতে জরাজীর্ণ এ সংস্থাটি বছর বছর ক্ষতির হিসাব দিতে অভ্যস্ত। যেখানে বিমান চিরকাল ইজারার মাধ্যমে বিমান সংগ্রহ করে সেখানে নতুন বিমান কেনার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ বোধগম্য নয়। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছে জমা থাকা ২৮ কোটি ডলার এবং বিভিন্ন বিনিয়োগে ৬ কোটি ডলার সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত জানা যায় না।
এর মধ্যে নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ৫ মাসের আমদানির ব্যয় মেটানোর সমতুল্য রিজার্ভ আছে। উনি কোন্ তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ বক্তব্য দিলেন অথবা কার পরামর্শে বা কিসের আশায় এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিলেন তা চিন্তার বিষয়। আপতঃদৃষ্টিতে রিজার্ভের পরিমাণ থেকে বাদ পড়া সংখ্যাগুলো হিসাবে নিলে দেখা যায় আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের একটু বেশি। অনেকের সন্দেহ হিসাবে আরও ফাঁক আছে, যেমন একটা কথা অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় হিসাবে শুধু পণ্যের মূল্য ধরেছে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট বীমা এবং পরিবহন খরচ ধরেনি। এখানে একটা বড় সমন্বয় হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশা দেখিয়েছেন জানুয়ারি থেকে রিজার্ভ সংকট আর থাকবে না। দৃশ্যমান পদক্ষেপ মাত্র তিনটি- আমদানি ঋণপত্র খোলায় মার্জিনের হার ক্ষেত্র বিশেষে ৭৫% থেকে ১০০%-এ নির্ধারণ, কিছু বিলাসসামগ্রী আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে ডলার সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া, যার ফলে পুরো নভেম্বরে নতুন আমদানি ঋণপত্র ভয়ঙ্করভাবে কমে যায়। সংকট এতটাই প্রকট বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমনেচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের ডলার একাউন্ট খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। ডলার আয় বৃদ্ধি এবং পাচার বন্ধ করার শক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে ব্যয় সংকোচনের পন্থা অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন করবে এবং বেকারত্বের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। তার উপর আমাদের সামনের বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক ঋণ শোধের পরিমাণ বাড়ছে। শ্রীলংকা ২০২০ সাল থেকে ব্যয় সংকোচনের নীতি অনুসরণ করে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সারের অভাবে কৃষি উৎপাদন ২০% কমে তাদের খাদ্য ঘাটতি ঘটেছে। কাগজের অভাবে শ্রীলংকায় ছাত্র-ছাত্রীদের জাতীয় পরীক্ষাসমূহ বাতিল করা হয়েছে। আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত প্রবাশী আয়ের প্রবাহ বৈধপথে বৃদ্ধি। বৈধ এবং অবৈধ পথে যখন ডলারের দামে ১০ টাকার তারতম্য থাকে তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এ ধারা চলতে থাকলে অবৈধ পথে ডলার লেনদেন আরও ফুলে-ফেঁপে উঠবে। অনেক আলোচনা সত্ত্বেও ডলার পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা, হিসাব নেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অন্যদিকে আইএমএফ বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডলারের চলতি হিসাবের ঘাটতি প্রায় ১৫০০ কোটি থেকে ১৬০০ কোটি হবে যদি না বৈদেশিক উৎস থেকে ১০০০ থেকে ১২০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত এর সুরাহা হয়নি। বরং ভারতের ক্ষমতাশীন দলের ঘনিষ্ঠ আদানীর কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার তোড়জোড় চলছে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের আশার বাণী নিশ্চয়তার বদলে শংকা বাড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার যা কিছু অবশিষ্ট আছে তার সম্মান রাখা। না হলে জনগণের সন্দেহ অবিশ্বাসে রূপ নেওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর তখন পরিস্থিতি সকলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং এর দায়দায়ীত্ব ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটির উপর বর্তাবে।
লেখক : শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)।