অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান/ অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা এখন সময়ের দাবী
প্রকাশ: ০৭:৪০ এএম, ১ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৫৯ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যাত্রাপথ কখনও মসৃন ছিল না। হাঁটি হাঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এগিয়ে চলেছে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপনিয়ে রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, জনপ্রিয় এবং স্বীকৃত শাসন ব্যবস্থা হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন।
গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আপন অস্তিত্ব এবং আধুনিক জীবন চেতনার বিকাশ প্রতিষ্ঠায় বৃটেনে জনগণের সাধারণ ইচ্ছার ‘General Will' প্রতিফলন প্রতিষ্ঠায় উদার‣নতিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রক্ষমতায় সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ভোট প্রদানের অধিকারকেই উদার‣নতিক ‘গণতন্ত্র’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নিদিষ্ট সময় অন্তর অনুষ্ঠেয় ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও সরকারের পরিবর্তনই আধুনিক উদার‣নতিক গণতন্ত্রের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত যা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান আইনসভার মাধ্যমে রূপ লাভ করে।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দু’লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গণতন্ত্র মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ সবসময় মসৃণ ছিল না। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ ঐক্যমতের ভিত্তিতেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হলেও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দূর্নীতি লুটপাট এবং নানাকারণে ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জনগণের ভিতর গণতন্ত্রের যে আশা আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়েছিল তার কবর রচনা করা হয়।
১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিল্পবের মধ্যে দিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিবেদিত হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে আধিপত্যবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন। জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে অবমুক্ত করেন, প্রতিষ্ঠা করেন বহুদলীয় গণতন্ত্র, ফিরিয়ে দেন জনগণের মৌলিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সমূহ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। দীর্ঘ নয় বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে পুনঃবার গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন। ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে পুণঃবার সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা রচিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠন ও পরিবর্তনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার সুযোগ লাভ করে। জাতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কার্যকর ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থাকে। সংসদে সরকারী দল ও বিরোধীদলের সরব উপস্থিতিতে সংসদ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও কার্যকর।
২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে গণতন্ত্রকামী সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। নবম জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের দোহাই দিয়ে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে বাংলাদেশে আবারো নতুন করে গণতান্ত্রিক অগযাত্রাকে হত্যা করে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে। কিন্তুএ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই সংঘটিত হয় বলে দেশে এবং বিদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। ফলে দশম জাতীয় সংসদের ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় সংসদে সরকারী দল এবং নামসর্বস্ব বিরোধী দল একাকার হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রা মসৃন পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে একথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না হলেও ১৯৯১, ১৯৯৬, এবং ২০০১ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কারচুপির অভিযোগ করলেও দেশে বিদেশে এবং বাংলাদেশের জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ ভোট প্রদানের অধিকার এবং সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে জনগণ ক্রমান্বয়ে ভোট, রাজনীতি, সরকার, এবং জাতীয় সংসদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে যা একটি দেশের জন্য অশনি সংকেত। এরূপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গত কয়েক বছর আগে সুপ্রীম কোর্ট বলেছিল “আমরা এমন একটা পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ভালো মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারছে না, রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে...আমাদের পূর্বসূরিরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্য নয়” (প্রথম আলো)।
বাংলাদেশের গত তিন দশকের রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রত্যাশা ও আকাঙ্খা নিয়ে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা সূচিত হয়েছিল তার যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থাকে এখন আর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এমনকি ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ কোনটাই বলা সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ এবং ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর বির্তকিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসক হিসেবে চিহ্নিত। ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের ধারা ‘হেজিমোনিক ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজম বা আধিপত্যশীল নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদে পরিণত হয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্র উদ্ধার এবং কার্যকর সংসদ বির্নিমানে জনগণকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার ভোট প্রদানে সক্রিয় করতে বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্র পুনঃউদ্ধারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অতি সম্পতি সকল বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ সফলভাবে সম্পন্ন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিপাদ্য বিষয় থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য তীব্র আকাংখা ছিল এ বঙ্গের জনগণের। কারণ গণতন্ত্র শুধুমাত্র একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, বরং গণতন্ত্র একটি দর্শন। যে দর্শনের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগসহ নানাবিধ বিষয় সমূহ বিদ্যমান, যার মধ্যে একটি সভ্য সমাজ বির্নিমান এবং উন্নত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার ফলে উপরিউল্লেখিত বিষয়গুলো প্রায় অনুপস্থিত।
এরূপ এক বাস্তবতায় গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত ’রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করা হয়েছে তা বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন সময়ের দাবী। যদিও বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার একটিও আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। অবশ্য আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়ারই কথা। কারণ আওয়ামী লীগ যদি উল্লেখিত দফাগুলো পছন্দ করত তাহলে তো আর এ রূপরেখা বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবে এই ২৭ দফা বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজ‣নতিক দল ও সংগঠন রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখাটি বিবেচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং তৃতীয় বিশ্বে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি বেগম খালেদা জিয়া’র ভিশন-২০৩০ যেমন ছিল একটি মাইল ফলক, ঠিক তেমনি তারেক রহমান কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্খিত এবং মানবিক বাংলাদেশ বির্নিমাণে যেসব বিষয়ের উপস্থিতি থাকা জরুরী সবগুলোই ২৭ দফার মধ্যে নিহিত আছে বলে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার, Rainbow Nation, উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ন্যায়পাল নিয়োগ, জুডিশিয়াল কমিশন, সার্বজনীন মানবধিকার সনদ বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি পরিহার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন, যুগোপযোগী এবং জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্বারোপসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল, অংশগ্রহণমূলক, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ২৭ দফা অবশ্যই একটি মাইল ফলক কোন সন্দেহ নেই।
পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্বে সমাজে দাস প্রথা চালু ছিল। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এখন দাস প্রথার পরিবর্তে নাগরিক শব্দটি প্রচলিত। যদিও বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের মধ্যে ধনীগরীব শব্দের ব্যবহার বিদ্যমান। এ কর্তৃত্ববাদী সমাজ এবং রাষ্ট্র বিশাল জনসমষ্টিকে রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত করে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র যদি কল্যাণমূলক হয় তাহলে এ বিশাল জনসমষ্টি সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে আদব, রীতি, নীতি এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী কাজ করলে সমাজের সাথে সমাজবদ্ধ জনগণের একটি চুক্তি তৈরী হয় যাকে সমাজের ‘অথরিটি’ বলা হয়। অর্থাৎ সমাজে রীতি-নীতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করলে যা সমাজ গ্রহণ করে না। ঠিক তেমনি, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার যে বৈধতা তাহল রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তি, যে চুক্তি অনুযায়ী জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় তাই হল বৈধতা। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে দু’টি নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তা শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠিত হয়নি বলে তার বৈধতা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে এ সরকার তাঁদের ক্ষমতাকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করার লক্ষ্যে সে সকল আইন প্রণয়ণ তথা কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে তা কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসেবে বিবেচিত। তন্মধ্যে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট’ যা কোনভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাম্য হতে পারে না। এরকম এক পরিস্থিতিতে বিএনপি’র ২৭ দফা রূপরেখা গণতন্ত্রমনা রাজ‣নতিক দল সমূহের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
বাংলাদেশের সিংহভাগ জনসমষ্টি তরুণ। শিক্ষিত তরুণদের বর্তমানে রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। তাছাড়াও সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা না থাকায় অনেক শিক্ষিতজনেরা রাজনীতিতে আসতে চান না। সুতারাং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখায় তরুণ এবং শিক্ষিত মানুষের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি ২৭ দফা রূপরেখায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি। কারণ একথা সত্য সমাজের মৌলিক ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষিত এবং তরুণ সমাজের বিশাল ভূমিকা আছে।
রাজনীতি বিমূখ ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষিত তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরী করতে না পারলে সমাজের মে․লিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫১ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের পাশাপাশি সমাজের সংস্কারও অত্যন্ত জরুরী। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরী। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক মূল্যবোধ অনাচার, অন্যায় এবং দূবৃত্তায়নের কবল থেকে সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। গৌরবময় অতীত, বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্মময় বর্তমানকে সামনে নিয়ে জাতির কাছে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের যে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে তা নি:সন্দেহে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় তথা গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার ক্সতরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ কথা
সত্য বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জনগণের চাহিদা এবং আচার আচরণে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে তথাপিও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরী।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান শর্ত হলো জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করা এবং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ‘জাতীয় সংসদ’ বা আইনসভা হবে সার্বভৌম। সেখানে ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ বা স্যাডো কেবিনেটের উপস্থিতি থাকবে। সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা হবে Watch Dog এর মত। মোট কথা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি Vibrant জাতীয় সংসদ বা আইনসভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন যা অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কর্তৃক রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র বির্ণিমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : ড. এ কে এম মতিনুর রহমান, প্রফেসর, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এবং সহ-সভাপতি, ইউট্যাব। ড. মোর্শেদ হাসান খান, শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও মহাসচিব (ইউট্যাব)।