অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান
শফিউল বারী বাবু : একটি নক্ষত্রের অকাল প্রয়াণ
প্রকাশ: ০৮:৪৯ এএম, ২৮ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৫৩ পিএম, ৯ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সফল সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু মৃত্যুকালে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শে আকৃষ্ট ও আলোকিত নক্ষত্র তুল্য এই নেতা কুমিল্লার ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, মতিঝিল মডেল হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পর্যায়ে কৃতি শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম অক্ষুন্ন রেখে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। ভাগ্যের পরিহাস, মাত্র ৫১ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী সকলের প্রিয় শফিউল বারী বাবু।
দেশপ্রেমে উজ্জীবিত অনন্য সাধারন সংগঠক শফিউল বারী বাবুর নামাজে জানাযায় তার রাজনৈতিক প্রতিভা ও অঙ্গীকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলামগীর অঝোরে কাঁদলেন। বিএনপির মহাসচিবকে স্বচক্ষে কখনো কাঁদতে দেখিনি। বাবুর মৃত্যুতে তার এই কান্না যেন সন্তানহারা পিতার বিলাপ। কি নিদারুন মায়া! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত ব্যথা? কি হারানোর এত ব্যথা? বাবুর সংক্ষিপ্ত অথচ বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবন বিশ্লেষণ করে যা পেলাম তাতে মনে হয়, তার এই অকাল প্রয়াণে দল ও দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, আর সেই বেদনাই বারিধারা হয়ে মহাসচিবের দুই নয়ন জুড়ে প্রবাহিত হয়েছে।
মোঃ সেলিম সাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিএনপি'র প্রভাবশালী নেতা জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ' শফিউল বারী বাবু একজন দায়িত্বশীল ও নিবেদিত প্রাণ নেতা। দলের সংকটকালে তিনি সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। দলের প্রতি তার অবদান বিএনপি আজীবন স্মরণ রাখবে (২৯/০৭/২০২০, বাংলা ট্রিবিউন)। জন্ম-মৃত্যু মানুষের জন্য মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ স্বরূপ। জন্মালে মরতেই হবে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শফিউল বারী বাবুর মৃত্যু কেন সকলের জন্য এত পীড়াদায়ক? এই বেদনার কারণ খুঁজতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই জ্ঞান অর্জনের মহান ব্রত পালনের পাশাপাশি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত শফিউল বারী বাবুর ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও আন্দোলন-সংগ্রামে রেখে যাওয়া বিশেষ অবদানই হল এই আর্তনাথের অন্যতম প্রধান একটি কারণ। ৯০-এর দশকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ছাত্র নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল সর্বজন স্বীকৃতি। এই সময়কার ছাত্র আন্দোলন হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রনেতাদের ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশে গণতন্ত্রহীনতা মেধাবী শিক্ষার্থী শফিউল বারী বাবুকে কলেজ জীবনেই গভীরভাবে বেদনা হত করেছিল। তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়ই দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার সংগ্রামে নিজের সবটুকু উজাড় করে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী এরশাদের বগলবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা গণতান্ত্রিক সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের অঙ্গীকার নিয়েই বাবুর রাজনীতির মাঠে সংগ্রামী জীবনের শুরু।
মুক্তির প্রকৃত চেতনায় উজ্জীবিত শফিউল বারী বাবুর রাজনৈতিক অঙ্গীকার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারই এক সহযোদ্ধা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী বলেন, ঢাকা কলেজ থেকে স্বৈরাচার বিরোধী এক ঝাঁক উচ্ছাসী রাজনৈতিকভাবে সচেতন তরুণ রাজপথ কাঁপিয়ে, অপারাজে বাংলার পাদদেশ, কলা ভবনের দালান-বারান্দা, ডাকসু ভবন হয়ে গোটা এলাকা প্রকম্পিত করে মধুর ক্যান্টিনে দিকে মিছিল নিয়ে আসছে- ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’; ‘ওই ছুটছে সেনা দল, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। মিছিলের পুরো ভাগে নেতৃত্বে দানকারী গাঢ় নীল বর্ণের হারা ব্র্যান্ডের জিন্স পরিহিত লাল ফুল স্লিভ গেঞ্জি গায়ে বালকটির নাম শফিউল বারী বাবু। ঐদিনই প্রথম তাকে চিনলাম। তারপর থেকে একসাথে পথ চলা কখনো থামেনি (বিডি প্রেস এজেন্সি, ৩০-০৬-২০২০)। এর ধারাবাহিকতায় শফিউল বারীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও উৎসর্গ করেছিলেন রাষ্ট্রকে স্বৈরাচার মুক্ত করার ধনুক-ভাঙ্গা পণ নিয়ে।
স্বল্পভাষী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তরুণ বাবুর মধ্যে ছিল অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি। আর সেই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও আনুজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনার উন্মেষ ঘটান স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে যুক্ত করার মাধ্যমে। তার এই অতুলনীয় দক্ষতার সুবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় প্ল্যাটফর্মে কর্মী সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যায়। তার এই সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা দল ছাপিয়ে বহুদলীয় তথা সার্বজনীন মাত্রা লাভ করে। শফিউল বারী সম্পর্কে নানা মত-পথের মানুষের হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির প্রকাশগুলো তার প্রয়াণকে আরো বেদনাবিধুর করে তোলে।
এ প্রসঙ্গে বাবু সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্রলীগের একজন নেতার মন্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, 'ছাত্রদলের রাজনীতির ইতিহাসে বাবু ভাইয়ের কাছাকাছি জনপ্রিয় সাংগঠনিক নেতা কখনো দেখিনি, ছিল বলেও বিশ্বাস করিনা। ছাত্রদলের বিশাল একটি ব্যাচ বাবু ভাইয়ের হাতে গড়া, যার সকল সদস্যই বাবু ভাইয়ের জন্য বুলেটের বিপরীতে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। এই গ্রুপটির উপর দাঁড়িয়েই বাড়ন্ত হয়েছিল ছাত্রদল'(দেশ রূপান্তর, ২৮-০৭-২০২০)।
তিনি আরো বলেন, '৯৩ সালে ১৫ ই আগস্ট আমি গ্রেপ্তার হলে কারাগারে পেলাম বাবু ভাইকে। খুবই আগ্রহ ছিল তাকে নিয়ে, কি এমন ছাত্র নেতা, যার জন্য জীবন বাজি রাখতে রাজি অসংখ্য ছাত্রদলের সাহসী কর্মী। এই গ্রুপটির প্রায় সবাইকেই যেহেতু আমি কমবেশি চিনি ... তাই চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজি করে খুব টাকা পয়সা কামানোর সুযোগ পেয়েছে বিধায় বাবুর নেতৃত্ব আস্তাশীল ছিল - বিষয়টি একদমই তেমন নয়। আমার জেলে কাটানো ৪৯ দিনের প্রতিদিনই তাকে একটু একটু করে চিনেছি। খুবই স্বল্পভাষী, ধীমান, সামাজিক দায়িত্বজ্ঞান সম্পূর্ণ প্রগতিশীল একজন ছাত্র রাজনীতিবিদ'(প্রাগুক্ত)। সামাজিক দায়বদ্ধতার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি তার আরেক অনুজ সহযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক দলের দপ্তর সম্পাদকের বর্ণনায় আর স্পষ্ট হয়ে উঠে।
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে কারাগারে থাকাকালীন সময়ে প্রতিদিন সকাল বিকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের আবাসস্থল যমুনা থেকে সূর্যমুখীতে ছুটে যেতাম বাবু ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য। গেলেই বিস্কুট, ফল খেতে দিতেন। সুবিধা অসুবিধা জিজ্ঞেস করতেন। সেখানেও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেলের মধ্যে কারা কারা কষ্টে আছে তাদের লিস্ট করার জন্য, কারা আইনের সুবিধা পাচ্ছে না, জামিন হচ্ছে না, টাকার অভাবে উকিল নিয়োগ করতে পারছে না, কার বাসায় খাবার নেই, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে পারছে না, তাদের লিস্ট করে দিতে। লিস্ট দিলে তিনি সব রকম ব্যবস্থা করতেন। একজন নেতার এমন মহানভবতায় জেলখানার সব শ্রেণীর বন্দীর মুখে শফিউল বারী বাবুর নামটি মানবতাবাদী নেতা হিসেবে উচ্চারিত হতো। জেলখানায় অনেক নেতা ছিলেন, কেউ কারো খোঁজ রাখেন না। কর্মীর প্রতি একজন নেতার কি পরিমান ভালোবাসা থাকতে পারে তা শফিউল বারী বাবুরকে জেলখানায় নিজ চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না' (মোঃ হারুন অর রশিদ, নয়া দিগন্ত, ০৯-১০-২০২০)।
উপরের মন্তব্যগুলো থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, শফিউল বারী বাবু ছিলেন অনন্য সাধারণ এক সংগঠক। তিনি ছিলেন অসাধারণ কর্মী বান্ধব, মানবতার চেতনায় উদ্ভাসিত এক সার্বজনীন মানুষ। মৃদুভাষী হলেও মানুষটি ছিল সকল স্বৈরাচার ও দূঃশাসনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও এক-এগারোর ফখরুদ্দিন- মইনুদ্দিনের অবৈধ মাইনাস টু রাজনীতির বিরুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা রাজনীতির ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে এক না ভুলা অধ্যায়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অবদান অব্যাহত রেখেছেন। বয়স ভেদে যথাযথ স্নেহ, মমতা ও শ্রদ্ধা বজায় রেখে সবার সঙ্গে মেশার ক্ষমতাই তাকে অনন্য উচ্চতা দান করেছে, সকলের ভালোবাসা এবং আস্থা অর্জনে সফল হয়েছেন। আর শফিউল বারীর এসব অর্জনের পেছনে মূলতঃ যেটি ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে গভীর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতিকে বুকে ধারণ ও চর্চা করা। এটা সত্য যে, বাবুর উপস্থিতি ও নেতৃত্ব এ লক্ষ্য অর্জনে অনেক বেশি সহায়ক হতো।
কিন্তু এক্ষেত্রে আশার জায়গা হল এই যে, বাবুর বিধবা স্ত্রী বিথীকা বিনতে হোসাইন তার শুধু সহধর্মিনী নন বরং তিনি বাবুর একজন সফল রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও অনুসারী। 'অর্পণ বাংলাদেশ' নামের সেবা সংগঠনের মাধ্যমে বহু দুস্থ ও হতদরিদ্রদের সেবা প্রদান করার মাধ্যমে ইতোমধ্যে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। বাবু লোকান্তরে কিন্ত স্ত্রী ও সহযোদ্ধারা মানবতাবাদী রাজনৈতিক চেতনাকে প্রবাহমান রেখে চলেছেন। মূল্যবোধের সামগ্রিক অবক্ষয়ের এই ভয়াবহ দুর্যোগের সময়ে শফিউল বারী বাবুর প্রয়াণ যে শূন্যতার সৃষ্টি করবে তা পূরণ করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। প্রয়োজন তার জীবন আদর্শের সঠিক উপলব্ধি ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে এর চর্চা করা। তার দেখানোর পথ ধরে তার স্ত্রীর অনুরূপ অগ্রসর হবেন বহুদূর, বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে, যতক্ষণ না মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার প্রকৃত লক্ষ্য (মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি) অর্জন না হবে। চেতনার বাতিঘর শফিউল বারী বাবুর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে এটাই হোক ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল সহ সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং জাতীয়তাবাদের অনুসারে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীসহ দেশবাসির প্রাণের অঙ্গীকার।
লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ কামরুল আহসান, দর্শন বিভাগ, জাহাগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)।