ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
প্রকাশ: ১১:৫২ এএম, ৬ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:১৪ এএম, ১১ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট নিকট অতীতের যেকোনো বাজেটের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন। বর্তমান বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। প্রায় দুই বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা শুরু হয়েছিল।
একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা ছিল দেশটির ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) পলিসি রেট বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে ইতোমধ্যে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হয়নি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অনেকেই ধারদেনা করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন।
সম্ভবত স্বল্পতম সময়ের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়, এ বিষয়টিই হবে আগামী বাজেটের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, খাদ্যপণ্যসহ বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এসব আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার যদি কমানো হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু সরকার যদি এসব পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হ্রাস পাবে। এমনিতেই আমাদের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বা হার খুবই কম। বিশ্বের যেসব দেশের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত কর হ্রাস করলেই যে স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য কমে আসবে, সেটা সঠিক নয়। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় একটি শক্তিশালী চক্র তৎপর রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধ করা না গেলে শুধু কর হ্রাস করে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাবে না। দেশে ভোক্তা অধিকার আইন আছে। কিন্তু সেই আইন কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের দেশে পণ্যের অভাব নেই। কিন্তু একটি মহল মাঝেমধ্যেই পণ্যের জোগান কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। কীভাবে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সে ব্যাপারে আগামী বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
তা ছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে পণ্য রাপ্তানি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। কিন্তু পণ্য রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স খাতের অবস্থা বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। এ দুই খাতের প্রবৃদ্ধি মোটেও সন্তোষজনক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস, অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে পণ্য রপ্তানি খাতে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আর জনশক্তি রপ্তানি খাতে জুলাই-মার্চ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। জনশক্তি রপ্তানি খাতে আহরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত পণ্য রপ্তানি এবং জনশক্তি রপ্তানি খাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত না হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।
দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়েও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত নানা কারণেই বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের মাত্রা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক, এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা, পুনঃতফসিলীকরণকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবি করা অর্থ যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা হবে বলে অনেকেই মনে করেন।
বিভিন্ন সময় খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও এর কোনোটিই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেনি। ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক এবং ঋণগ্রহীতাদের পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে বড় বড় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণ মঞ্জুর করছেন। এসব ঋণের কিস্তি পরে আর আদায় হচ্ছে না। ব্যাংক খাতে বিদ্যমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসন্ন জাতীয় বাজেটে ব্যাংক খাত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা আসতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু এ উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতে শুরু করেছে। কাজেই শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগ কতটা সুফল দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছুদিন আগেই ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে ব্যাংকঋণের সুদের হার যদি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সুদের হার অনেক বৃদ্ধি পাবে। কারণ, আমানতের প্রবৃদ্ধি খুব একটা সন্তোষজনক নয়। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এখনো বিনিয়োগকারীদের আস্থার স্থানে পরিণত হতে পারেনি।
তাই ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা তাদের পুঁজির চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে থাকেন। বাংলাদেশ যেহেতু আমদানিনির্ভর একটি দেশ, তাই ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেলে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্যসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সুদের হার বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন তুলনামূলক ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। এখানে কিছুটা ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করেছে। আমি মনে করি, এ পথে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক এ মুহূর্তে যদি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে পণ্য রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যারা এখন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করছেন, তারা হয়তো বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে উৎসাহিত হবেন। একই সঙ্গে রপ্তানি আয়ের যে অংশ এখন দেশে আসছে না, তাও হয়তো দেশে আসবে। কিন্তু এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা