আবু জাফর সাঈদ
কিশোর গ্যাং : সুস্থ প্রজন্ম রক্ষার্থে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে
প্রকাশ: ০১:২৮ পিএম, ২২ মে, বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৫৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বর্তমান দেশে অন্যতম আতঙ্ক ও উদ্বেগের নাম কিশোর গ্যাং। নৈতিক অবক্ষয়ের অতলান্তিকে ধাবিত হচ্ছে কিশোররা। পশ্চিমাদেশীয় ‘গ্যাং’ শব্দটি এদেশে তেমন পরিচিত ছিল না। বিগত বছর দশেক থেকে বাংলাদেশে বিপদগামী কিশোরদের কাছে শব্দটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর বীভৎস চিত্র আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহ অপরাধের ছোঁয়াচে আক্রান্ত হচ্ছে যুবসম্প্রদায়ও। ফলে এই ক্ষত চিহ্ন হবে দীর্ঘায়িত, কুফল ভুগতে হবে পুরো জাতিকে। কাজেই, এখনই সময় কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা পথ রুদ্ধ করে সুন্দর-সুবাসিত মসৃণ পথে তাদের ধাবিত করা।
গত ৮ মে, বুধবার চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় আকমল আলী রোডে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নির্মমভাবে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান মেহেদি হাসান নামে এক তরুণ। অপর দুজন মারাত্মকভাবে আহত হন। মাত্র মাস খানেক আগে গত ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ডাক্তার কোরবান আলী।
চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ আবাসিক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের আক্রমণে শিকার সন্তানকে বাঁচাতে এলে দন্ত চিকিৎক কোরবান আলী নিজেই আক্রান্ত হন। তিনি ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর মারা যান ডাক্তার কোরবান আলী। এই প্রেক্ষিতে জানা যায়, চট্টগ্রামে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে এবং সদস্য সংখ্যা এক হাজারের উপরে। তাদের গডফাদারের সংখ্যা শ-দুয়েক বলে জানা যায়। গত ছয় বছরের সাড়ে পাঁচশটি ঘটনা ঘটেছে এবং এর মধ্যে ৩৫টি হচ্ছে হত্যাকাণ্ড।
গেল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে পাইকপাড়ার ইছাপুর গ্রামে রাসেল নামের এক যুবক নিজ মাকে জবাই করে হত্যা করে। গত বছরের ৮ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে এক ছাত্রের হাতে একজন শিক্ষক প্রহৃত হবার ঘটনা সবার জানা। ভাইরাল হওয়া ঘটনায় দেখা যায়, ওই স্কুলের শিক্ষক হাফিজুর রহমান এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষার দায়িত্ব পালনকালে নকলে করতে বাধা দেওয়ায় সাইফুল আলম নামের এক ছাত্রের দ্বারা মারাত্মকভাবে আহত হন।
পরে ওই শিক্ষকের মামলার প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত ছাত্র সাইফুল আলমকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠায় আদালত। কিশোর গ্যাংয়ের এই চিত্র কেবল রাজধানী ঢাকা বা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশে এর ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে। সূত্রমতে, সারা দেশে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয় হাজারের মতো। রাজধানী ঢাকাতেই কিশোর গ্যাং রয়েছে শতাধিক এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। শহর, গ্রামগঞ্জ, বন্দর সর্বত্রই কিশোর গ্যাং এবং এদের অপকর্ম ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে।
কীভাবে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে?
প্রতিপক্ষ বা প্রভাবশালীদের হামলা থেকে বাঁচতে অথবা নিজেদের সুসংহত অবস্থা জানান দিতে ৫/৬ জনের গ্রুপ সৃষ্টি করে। এরপর তাদের দ্বারা কিছু অপরাধ সংঘটিত থাকে এবং গ্রুপের সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। প্রতিটি গ্যাংয়ের আকর্ষণীয় নাম এবং লোগো ধারণ করে। নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য বাড়াতে শুরু করে হাইজ্যাকিং। তাদের মাথার উপর ছায়ার মতো অভয় নিয়ে দাঁড়ায় তথাকথিত ‘বড় ভাই’রা। এই সব ‘বড় ভাই’রা বেশির ভাগই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। ‘বড় ভাইয়েরা’ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এইসব কিশোর গ্যাংকে দারুণভাবে ব্যবহার করে। বিনিময়ে এই কিশোররা আর্থিক সমর্থন এবং অস্ত্রের সহায়তা পেয়ে থাকে। জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহারের সঙ্গে।
পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা ও ‘ডিমান্ড’কে কেন্দ্র করে মূল গ্যাং ভেঙে একাধিক গ্যাং তৈরি হয় এবং সৃষ্টি হয় নতুন নতুন ‘গ্যাং লিডার’। রাজনৈতিক ভিন্ন মত বা মতাদর্শের ওপর হামলা ছাড়াও তথকথিত ‘বড় ভাই’রা মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, হাইজ্যাক, জায়গা দখলের মতো অপরাধ সংগঠনে এই সব কিশোর গাংকে মারাত্মকভাবে অপব্যবহার করে থাকে।
অপরদিকে এসব কিশোররাও তাদের বয়সের কারণে কোনো রকম সাজা হবে না মর্মে বড় ভাইদের কাছ থেকে অভয় পেয়ে থাকে। এ ছাড়াও বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধার নিশ্চয়তা তো আছেই। তথাকথিত ‘বড় ভাই’ ছাড়াও ভূমিদস্যুরাও এদের খুব ভালো রকম ব্যবহার করে থাকে।
কিশোর গ্যাং এ জড়াচ্ছে কারা?
কিশোর গ্যাংয়ের জড়িতদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা। নিম্ন আয়ের লোকরা সারা দিন রুটি রোজগারের জন্য লড়াই করে। ‘নুন আনতে পান্তা শেষ হয়ে যাওয়া’ এই সব পরিবারের শিশু-কিশোররা অযত্নে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠে। একপর্যায়ে এইসব শিশু কিশোররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং ভালো-মন্দ বোধ তাদের থাকে না। ফলে কিশোর গ্যাংয়ের মতো গ্রুপগুলোর প্রতি তাদের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই আকর্ষণ থেকে এবং ‘বড় ভাই’দের উৎসাহে তারা প্রথমে স্বল্পমাত্রার, পরে বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে।
এর মধ্যে কারো কারো যখন বোধোদয় হয়ে তখন আর ফেরার সুযোগ থাকে না। গ্যাং লিডার ও বড় ভাইদের কাছ থেকে মামলায় জড়ানো এমনকি হত্যার হুমকিও পেয়ে থাকে। ফলে তাদের ফেরার ইচ্ছে জাগলেও ফিরতে পারে না। মধ্যবৃত্ত ও উচ্চবৃত্ত থেকে কিছু কিছু কিশোর এসব গ্যাং জড়াচ্ছে। এ ছাড়াও পরিবারের অব্যবস্থাপনা, সন্তানদের প্রতি অবহেলা ও খোঁজখবর না রাখা, অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির ব্যবহার, বিদেশি সংষ্কৃতির প্রভাবও কিশোরদের এ পথে আসতে সাহায্য করে।
কিশোরদের সাথে সাথে বর্তমানে কিশোরীরাও এসব ‘গ্যাং’-এর সাথে জড়াচ্ছে। কিশোরীদের দিয়ে অস্ত্র চালানো এবং মাদক পাচার অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
বিরাজমান প্রক্রিয়ায় কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ সম্ভব কী?
বর্তমান প্রশাসনিক ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় ‘কিশোর গ্যাং’ নামক অপকালচার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। পুলিশ আসছে, কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং কেউ কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। আবার জড়ো হয়ে নতুন করে অপরাধ করছে। অপরাধ বড় হলে পুলিশ ধরে আদালতে সোপর্দ করছে। কিশোর হওয়ার কারণে এদের বিচার প্রক্রিয়ায় আদালতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ মতে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে। ফলে এদের অপরাধ প্রাপ্ত বয়স্কদের ছাপিয়ে গেলেও বয়সের কারণে এরা আদালত থেকে পার পেয়ে যায়। কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া হওয়ার এটা অন্যতম কারণ।
হত্যার মতো অপরাধে আদালত সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড দিতে পারে। ২০১৮ সালে ২০ জানুয়ারি খুলনা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ৭ম শ্রেণির ছাত্র রাজিন কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের ২২ মে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্ত ১৭ জন কিশোর অপরাধিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। মাস দুয়েক পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে এসব অপরাধিরা। অভিযুক্ত ১৭ কিশোররা সবাই ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী।
উত্তরণের উপায়
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলে এর প্রতিরোধ সম্ভব বলে আমি মনে করি।
** দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। সন্তান ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কি না এ ব্যাপারে অভিভাবকদের জবাবদিহীতায় আনতে হবে।
** খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ এবং বিনোদনের জন্য পার্ক থাকতে হবে। শহরগুলোতে খেলাধুলার মাঠ ও পার্ক অনেক কম। ফলে শিশু- কিশোররা খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ খুব কম পায়।
** শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীক এক্সটাকারিকুলাম বাড়াতে হবে। এতে ছাত্ররা আনন্দ পাবে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে।
** কিশোর সংশোধনাগারগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে মনোবিকাশ ও সংশোধনের যথেষ্ট সুযোগ থাকবে।
** রাষ্ট্রের সম্পদ মনে করে রাষ্ট্রকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। জাতির কর্ণধার হিসেবে গড়ে তুলতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
** মসজিদের ইমামসহ ধর্মীয় ব্যক্তিদের ধর্মীয় আলোচনায় শিশু-কিশোরদের সুন্দর জীবন গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আলোনা করতে হবে।
**তথাকথিত ‘বড় ভাই’, ‘গড়ফাদার’, ‘ভূমিদস্যু’দের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
এখনই সময়, সরকারের সঠিক নির্দেশনায় দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদেরকে বাঁচাতে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি করা। সুন্দর, সুমহান ও ইতিবাচক পরিবেশে বেড়ে ওঠে এই শিশু-কিশোররই আগামী বাংলাদেশকে বিশ্ব আসনে নিয়ে যাবে।
আবু জাফর সাঈদ: সাবেক সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ, জেদ্দা