মঞ্জুরে খোদা
ইউক্রেনে নতুন মার্কিন সহায়তার সম্ভাব্য পরিণতি
প্রকাশ: ০৫:২৪ পিএম, ৩০ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:৪৪ এএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গত সপ্তাহে মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সিনেটে ইউক্রেনের জন্য ৬১ বিলিয়ন ডলার (সাত লাখ কোটি টাকারও বেশি) সহায়তা প্যাকেজ পাস হয়। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত আইনে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার নামে এ প্যাকেজে আরও তিনটি বিল পাস হয়, যেখানে ইসরায়েল ও বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার জন্য ২৬ বিলিয়ন ডলার (প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা) দেওয়ারও কথা আছে।
বিল পাসের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখা এক বার্তায় বলেছেন, এ সহায়তা মানুষের জীবন বাঁচাবে এবং যুদ্ধের ‘যৌক্তিক সমাপ্তি’ আনবে। তবে শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান মার্কিন সিনেটর মিচ ম্যাককলেন দাবি করেছেন, মস্কোর বিরুদ্ধে কিয়েভকে অর্থ দিয়ে আসলে মার্কিন জনগণের স্বার্থের ক্ষতি করা হচ্ছে।
মার্কিন সাহায্য পেয়ে জেলেনস্কি রাশিয়াকে পরাজিত করে ইউক্রেনের হারানো ভূমি উদ্ধার করার স্বপ্ন দেখছেন। রাশিয়ার দখলে বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ জমি রয়েছে। তদুপরি, রুশ বাহিনী ক্রমে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইউক্রেনের ভেতরে প্রবেশ করছে। তারা কিয়েভ দখল ও পতনের অভিপ্রায় নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন এমন ঘোষণাই দিয়ে রেখেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, জেলেনস্কি যে হারানো ভূমি উদ্ধার ও রাশিয়াকে পরাজিত করার কথা বলছেন, সেটা কি সম্ভব? ২০১৪ সালে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া ও দোনবাস নামে যে অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, গত ১০ বছরে কিন্তু তা তিনি উদ্ধার করতে পারেননি।
কতটা বাস্তবতা ও ইতিহাস জ্ঞানহীন হলে একজন রাজনীতিক যুদ্ধের তৃতীয় বছরে পতনের মুখে এসে এমন কথা বলেন! মার্কিন-নির্ভরতা একজন রাষ্ট্রনায়ককে কতটা নির্বোধ করতে পারে, তার বড় উদাহরণ জেলেনস্কি। ভুল ছকে ছবির মতো একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় দেশকে কীভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেন! তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ– আমেরিকা যাদের মিত্র, তাদের জন্য বাইরের শত্রুর দরকার নেই। ইউক্রেন কি এর আরেকটি উদাহরণ নয়?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ-রাজনীতিকদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। কেউ বলছেন শান্তি আলোচনার মাধ্যমে, কেউ বলছেন ব্যাপক আক্রমণ করে পুতিনের পতন অথবা সম্মানজনক এক্সিটের মাধ্যমে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই দৃশ্যমান নয়; যুদ্ধ বরং দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় কোনো কোনো পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞ ইউক্রেনের পতনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। গত মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও উদ্বেগের সঙ্গে দ্রুত ইউক্রেনের পতনের কথা বলেছেন। এ মাসে পলিটিকো তাদের গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম– ‘পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন’।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইউক্রেনের মার্কিন সহায়তা বিল ছাড় পাওয়ার একটি বড় কারণ ইসরায়েল। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল-গাজার যুদ্ধ তাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। মার্কিন ইহুদি লবির চাপে ইসরায়েলকে নতুন অনুদান না দিয়ে উপায় নেই; প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারাও চায় ইউক্রেনের প্রতি এই ছাড়। অর্থের নিশ্চয়তা পেয়ে জেলেনস্কি হুংকার ছাড়লেন রুশকে পরাজিত করে দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? অন্যের করুণা, শক্তি ও সাহায্যের ওপর নির্ভর করে কোনো পরাশক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জেতা যায় না। মার্কিন সাহায্য নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ বলেছেন, ‘মার্কিন জনগণের টাকা ইউক্রেনের জলেই পড়বে।’
এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ দেখা গিয়েছিল, তার অনেকটাই হয়েছিল পশ্চিমাদের অতি উৎসাহ ও ইন্ধনে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, তাদের মধ্যে ক্লান্তি ও হতাশা তৈরি হয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে অভিবাসী। বস্তুগত ও মানবসম্পদের অভাবনীয় ক্ষতি তো রয়েছেই।
রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান নিয়ে অনেকে মন্তব্য করেছেন– রাশিয়ার মতো পরাশক্তি এত দিনেও ইউক্রেনকে দখল করতে পারল না! এটাই তো ইউক্রেনের বিজয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ফিলিস্তিনের গাজা হচ্ছে ৪১ বাই ১০ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, যা বাংলাদেশের একটি মাঝারি উপজেলার সমান। জনসংখ্যা ২৩ লাখ এবং হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৪০ হাজার। অন্যদিকে ইসরায়েলের নিয়মিত ও রিজার্ভ সৈন্য ৬ লাখ ৩৫ হাজার; হামাসের প্রায় ১৬ গুণ। অথচ ৭ মাসের যুদ্ধে পশ্চিমা বিপুল অর্থ ও সামরিক সহায়তা নিয়ে ইসরায়েলের বর্বর বাহিনী গাজার ৩৪ হাজার নাগরিক হত্যা করেও উপত্যকাটি দখল করতে পরেনি।
ইসরায়েল গাজায় যে মাত্রার গণহত্যা ও বর্বরতার ইতিহাস তৈরি করেছে, তা সমকালে নজিরবিহীন। রাশিয়া তার আংশিক করলেও হয়তো ইউক্রেনের পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। পশ্চিমা দুনিয়া ও সংবাদমাধ্যম তখন মাতম করত। প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা সাড়ে ১০ হাজারের মতো। আর ছয় মাসে গাজায় হত্যা করা হয়েছে এর তিন গুণ মানুষকে। গাজায় শুধু নিহত শিশুর সংখ্যাই প্রায় ১৫ হাজার।
মার্কিন সরকারের ৬১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তায় ইউক্রেন কতদূর যাবে, এ প্রসঙ্গে টাইমসে প্রকাশিত বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক স্টেফান উলফের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। সেখানে তিনি বলেন, ‘মার্কিন সহায়তা হয়তো ইউক্রেনকে একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার অবস্থা করে দেবে। সেখানে রাশিয়ার যে স্থিতিশীল অগ্রগতি হচ্ছে তার গতি হয়তো কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবে; তবে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা কঠিন।’
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক