ডেভিড লিওনহার্ড
ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার ভবিষ্যৎ
প্রকাশ: ০৩:৫৭ পিএম, ২০ এপ্রিল,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:০৬ এএম, ১৮ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
এতদিন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছায়াযুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত শনিবার ইসরায়েলে ইরানের মিসাইল ও ড্রোন হামলা এবং তার সম্ভাব্য জবাবরূপে গতকাল ইরানে ইসরায়েলের ‘মিসাইল’ হামলা চিরবৈরী দেশ দুটোকে মুখোমুখি করে দিয়েছে। এ ঘটনার কারণ ও পরিণাম বুঝতে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে সাম্প্রতিক তিনটি ধাপে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
ধাপ-১: বিষয়টা তর্কযোগ্য হলেও গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগে ইরান ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন শক্তি। বাইডেন প্রশাসন ইরানের দীর্ঘদিনের শত্রু সৌদি আরবকে ধীরে ধীরে কাছে টানছিল। ট্রাম্পের সময় ইসরায়েল বাহরাইন, মরক্কো ও আরব আমিরাতের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। অন্যদিকে ইরান হামাস ও হুতিদের মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছিল। অর্থাৎ স্পষ্টত তখন ইরানের প্রভাব ও আগ্রাসন ঠেকাতে আরব দেশ, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বড় ধরনের একটি জোট গড়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলছিল।
ধাপ-২: ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার কারণে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন বিশ্বের মনোযোগ কাড়ে, যাতে ইসরায়েলকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ যখন গাজায় ভোগান্তি কমিয়ে আনতে ও যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নিতে ইসরায়েলি নেতাদের ওপর চাপ দিচ্ছিল তখন আরব নেতারাও ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছিলেন। এ সময় ইরানবিরোধী জোট দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল।
ধাপ-৩: গত সপ্তাহে সর্বশেষ ধাপটি শুরু হয়েছে। ১ এপ্রিল সংঘটিত ইসরায়েলি আক্রমণের জবাব হিসেবে ইরান মিসাইল ও ড্রোন নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ইসরায়েলি হামলায় ইরানি সামরিক কমান্ডার মারা যান, যারা হামাসের মতো অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করেন। পাল্টা আক্রমণ হিসেবে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালিয়েছে। তবে ইরানবিরোধীরা তখন হামলা রুখে দিতে আবারও জোটবদ্ধ হয়। ইরানের ছোড়া মিসাইল প্রতিহত করতে মার্কিন কর্মকর্তারা ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। সেখানে যুক্ত ছিল ব্রিটিশ ও ফ্রান্স। আরব দেশগুলো গোয়েন্দা সহযোগিতা দিয়েছে। স্বয়ং জর্ডান গুলি করেই কিছু ড্রোন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন হামলার ব্যর্থতা নিয়ে মন্তব্য করছিলেন, তখন তিনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর পাশেই বসা ছিলেন। দেশটিতে নিয়োজিত মিসাইল ব্যাটারিই যুক্তরাষ্ট্র ইরানি হামলা ঠেকাতে ব্যবহার করেছে। যদিও ইরান ইসরায়েলে ৩ শতাধিক ড্রোন ও মিসাইল নিক্ষেপ করেছে, যৌথভাবে প্রতিহত করার ফলে ইসরায়েলে একজন বেসামরিক লোকও নিহত হয়নি। বাইডেনের উপদেষ্টা জন কিরবি হামলার ফলাফল সংক্ষেপে তুলে ধরতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘ইসরায়েল অধিকতর শক্তিশালী, ইরান দুর্বলতর এবং তাদের জোট আরও বেশি সংঘবদ্ধ।’
নতুন এক ধাপ: কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংঘাত লাগিয়ে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লুটতে চান। ম্যারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির শিবলি তেলহামি দ্য টাইমসকে বলেছেন, ‘এই লড়াই নেতানিয়াহুর দুটি স্বার্থে কাজে লাগবে। গাজার ভয়াবহ দুর্দশা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, যা ইস্যু পরিবর্তনের পথ হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এ ঘটনায় হয়তো তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে সহানূভূতিও পাবেন।’ ইসরায়েল সাইবার হামলা, গুপ্তহত্যা অথবা অন্য দেশে ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে হামলার কথা ভাবছে বলে মনে হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন মনে করে, যে কোনো ধরনের হামলা ইসরায়েল নয়, ইরানকেই বিচ্ছিন্ন করে দিতে ভূমিকা রাখবে।
আরব নেতাদের জন্য হুমকি: আরব নেতারা কেন ইসরায়েলের সঙ্গে জোট বাঁধতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন? শুনতে অবাক লাগবে, তাদের অনেকে ইসরায়েলের চেয়ে ইরানকে বড় সমস্যা মনে করে, যদিও প্রকাশ্যে তারা এটা বলে না। যেসব চরমপন্থি গোষ্ঠীকে ইরান টাকাপয়সা ও অস্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ করে, তারাই অঞ্চলটিকে অস্থির করছে। যেমন বিগত কয়েক বছর হুতিরা সৌদি আরব ও দুবাইয়ে হামলা চালিয়েছে। হামাস মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা, যাকে মিসর সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঘৃণা করে আসছে। আরব নেতারা মনে করেন, তাদের সরকারের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ইসরায়েল নয় বরং ইরান ও তার বৈদেশিক নেটওয়ার্কভুক্ত গোষ্ঠী। কূটনৈতিক সাংবাদিকতায় নিয়োজিত সহকর্মী মাইকেল ক্রাউলি বলেছিলেন, ‘আরব নেতা অনেকেই হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং এটিকে ধ্বংস করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন।’ ইরানবিরোধী জোট কেন আবার চাঙ্গা হলো, তার ব্যাখ্যা এর মধ্যে আছে। অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে, জোট হিসেবে এটি ভঙ্গুর। আরব দেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে সহজে জোট হবে না। অন্তত ইসরায়েল যখন গাজা কিংবা অন্য কোনো জায়গায় যুদ্ধে লিপ্ত, তখন এই জোট টিকে থাকতে পারে না।
ডেভিড লিওনহার্ড; সাংবাদিক ও কলামিস্ট; দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম