ড. মো. তাবারক হোসেন ভূঁঞা
ব্যাংক একীভূত নীতিমালা নিয়ে উদ্বেগ ও পর্যবেক্ষণ
প্রকাশ: ০৬:৩৯ পিএম, ১৮ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৪৬ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
চলতি মাসের ৪ তারিখে নীতিমালা জারি হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যাংক একীভূত হওয়ার খবর ক্রমেই প্রকাশ হচ্ছে। ১৯৯১ সালের (২০২৩ সালে সংশোধিত) ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫, ৪৯, ৭৭, ৭৭/ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ব্যাংক কোম্পানি একীভূত নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
নীতিমালা নিয়ে কিছু উদ্বেগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। নীতিমালা ও নীতিমালা সম্পর্কিত উদ্বেগ নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ এ নিবন্ধে তুলে ধরতে চাই।
প্রথমত, ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন আমাদের ছিলই; কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনীও এসেছে। আইনি কাঠামোর অধীনে সুস্পষ্ট নীতিমালার দাবি আগে থেকেই ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটা পূরণ করল। যদিও ব্যাংক একীভূতকরণ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের কা খুব সহজ ছিল না। কারণ একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে নতুন। এ অবস্থায় জারি করা নীতিমালায় কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। সেগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনে সংশোধন করে নেওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ (এমঅ্যান্ডএ) সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। এই নীতিমালা জারির মাধ্যমে এ বিষয়ে জনমনে একটা প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি হবে। উল্লেখ্য, এমঅ্যান্ডএ একটি বিশেষায়িত বিজনেস স্ট্র্যাটেজি। একটি নীতিমালা দিয়ে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ধারণা দেওয়া সম্ভব না হলেও বিষয়টি নিয়ে চর্চার নির্ভরযোগ্য দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল।
তৃতীয়ত, অনেককেই বলতে শুনেছি, বাংলাদেশে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের (এমঅ্যান্ডএ) কোনো আইন নেই। কথাটা ঠিক না। কারণ একটি মাত্র আইন করে এই একীভূত বা অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে দরকার একগুচ্ছ আইন, যা আমাদের দেশে রয়েছে। যেমন কোম্পানি আইন, কম্পিটিশন আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, পরিবেশ আইন প্রভৃতি।
চর্তুথত, এই নতুন নীতিমালা সংশ্লিষ্ট স্টকহোল্ডার ও স্টেকহোল্ডারদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়। এ নীতিমালার মাধ্যমে তারা একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা পাবে; সেই সূত্র ধরে অধিকতর অধ্যয়ন ও তথ্য সংগ্রহের অপেক্ষাকৃত সহজ উপায় খুঁজে পাবে।
পঞ্চমত, ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথাবার্তা শোনা গেলেও সিরিয়াস কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান ছিল না। নীতিমালা জারি হওয়ায় ব্যাংক একীভূতকরণ সম্পর্কে গুরুত্ব সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে সবুজ, হলুদ ও লাল জোনে থাকা ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ, ম্যানেজমেন্ট, গ্রাহক, আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্টদের টনক নড়বে।
ষষ্ঠত, প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী টার্গেট ব্যাংকের কর্মচারীদের একীভূত হওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে না। শুধু তাই নয়, টার্গেট ব্যাংকে কর্মরত থাকা অবস্থায় তারা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন– একই বেতন ও শর্তে তাদের হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংকে বহাল রাখতে হবে। নীতিমালার এ অংশ সমালোচনার দাবি রাখে। কারণ এটা একীভূতকরণের মূল উদ্দেশ্য অর্জনের অন্তরায়। একীভূতকরণ-পরবর্তী পর্যায়ে বাড়তি খরচের দায় চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর। এ পর্যায়ে ‘টার্গেট’ বা ‘দুর্বল’ ব্যাংকের জনবল পর্যালোচনা এবং চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। হিউম্যান রির্সোস ডিউ ডিলিজেন্সের সময় কোন কোন কর্মচারীকে বহাল রাখা হবে আর কাদের টার্মিনেট করতে হবে, তা নির্ধারণপূর্বক একীভূতকরণ স্কিমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
সপ্তমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জারি করা নীতিমালার ৩(২)(ক)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষা, আর্থিক এবং আইনি ডিউ ডিলিজেন্স সম্পন্ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত এক বা একাধিক নিরীক্ষা ফার্ম। এখানে মনে হয় একটু ফাঁক রয়ে গেল। একীভূতকরণ সংক্রান্ত আইনি ডিউ ডিলিজেন্স করার জন্য এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজ্ঞ রয়েছেন– এমন এক বা একাধিক ল ফার্ম নিয়োগ করাই সঠিক হবে। তা ছাড়া আর্থিক ডিউ ডিলিজেন্স করার জন্য দরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর্থিক পরামর্শক ফার্ম। নিরীক্ষা ফার্মের কাজ মূলত আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষা এবং কমপ্লায়েন্স ইস্যু হ্যান্ডেল করা। এখানে দেখা যায়, নিরীক্ষা ফার্মকে আর্থিক ডিউ ডিলিজেন্স এবং আইনি ডিউ ডিলিজেন্সসহ মোট তিনটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ডিউ ডিলিজেন্সের অধীনে নরমালাইজড হিস্টোরিক্যাল উপার্জন, ফোরকাস্টেড উপার্জন, ইন্টিগ্রেশন সমন্বয়, প্রোফরমা সমন্বয়, উপার্জনের মান নির্ণয়, পরিচালন ব্যয় নির্ণয়, মূলধন খরচ (কস্ট ক্যাপিটালাইজেশন) নির্ণয়, সেলিং জেনারেল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কস্ট নির্ণয় প্রভৃতি টেকনিক্যাল কাজ শুধু নিরীক্ষা ফার্ম কতটুকু দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে, তা ভেবে দেখা দরকার।
অষ্টমত, নীতিমালায় বলা হয়েছে– বিলুপ্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে একীভূত ব্যাংক কোম্পানির পদে রাখা যাবে না। শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উপরোক্ত তিনটি পোস্ট ছাড়াও সিএফও, সিটিও, মানবসম্পদ-প্রধান– এসব পদও কোনো ব্যাংকে একটিই থাকে। এসব পদের ব্যাপারে নীতিমালায় কোনো উল্লেখ নেই।
নবমত, নীতিমালা জারির পর কিছু পর্যবেক্ষণ বা উদ্বেগ পত্রিকান্তরে উঠেছে। যেমন– ব্যাংক একীভূত হওয়ার নীতিমালায় দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগের সঙ্গে আমার ভিন্নমত রয়েছে। নীতিমালার ৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একত্রীকরণের পর দুর্বল ব্যাংকের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো পরিচালক হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন না। তবে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওই সময় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও উপযুক্ততা সাপেক্ষে তিনি পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। প্রশ্ন উঠেছে, যাদের কারণে ব্যাংক খারাপ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পাঁচ বছর পর তাদের পর্ষদে ফেরার বন্দোবস্ত রাখা হলো কেন? আসলে পাঁচ বছর বাধ্যতামূলক পর্ষদের বাইরে থাকাও এক ধরনের শাস্তি। পাঁচ বছর পর শর্ত সাপেক্ষে তারা পর্ষদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেই যে তারা পর্ষদে ফিরতে পারবেন, তা কিন্তু না। ওই পর্ষদে পরিচালকের পদ শূন্য থাকতে হবে; পর্ষদের সংখ্যাধিক্য সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে; তবেই পাঁচ বছর পর টার্গেট ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে যুক্ত হতে পারবেন। ব্যাপারটা খুব সহজ না।
উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান, দ্রুততার সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানি একত্রীকরণের জন্য অনুসরণীয় নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই কিছু ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংক সংস্কারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। সময় সময় উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ বা পরামর্শ এলে তা বিবেচনা করে সংশোধনী আনা হলে ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালাটি আরও বেশি উপযোগী হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ড. মো. তাবারক হোসেন ভূঁঞা: হেড অব চেম্বার, জুরিসকনসাল্টস অ্যান্ড লিগ্যাল সলিউশনস (জেএলএস)