জাভেদ আলী
ইসরায়েল ও ইরান নতুন ধরনের ছায়াযুদ্ধের পথে?
প্রকাশ: ০৫:২৮ পিএম, ১৮ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:৩০ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছিল কয়েক দশক ধরে। সাইবার হামলা অথবা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও আগুনঝরা বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের মধ্যেই সেটা সীমিত ছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহজুড়ে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাগুলো দুই দেশের সংঘাতের ধরন পাল্টে দিয়েছে।
প্রথমত, ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি মিশনে বোমা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে। ওই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস বা কুদস বাহিনীর সাত সদস্যসহ মোট ১২ জন নিহত হয়েছিল। হামলাটির মধ্য দিয়ে ইসরায়েল দেখাতে চেয়েছিল– মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শক্তিকেই তারা পরোয়া করে না। এর আগে কখনও ইরানের প্রতিপক্ষের কোনো একক হামলায় কুদস কিংবা দেশটির অন্য কোনো বাহিনীর এত সদস্য একসঙ্গে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। হামলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইরানের পক্ষ থেকে শিগগিরই সমুচিত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তেহরানের নেতারা।
দ্বিতীয়ত, গত ১৩ এপ্রিল ইরান সেই হামলার জবাব দেয়। এর মধ্য দিয়ে ইরান এমন এক রেখা অতিক্রম করে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ইরান থেকে ইসরায়েলের ভূমিতে আগে কখনও সরাসরি হামলা চালানো হয়নি। ইসরায়েল দেখাতে চেয়েছিল– তারা মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো দেশের স্বার্থ বা স্থাপনায় হামলা চালানোর অধিকার রাখে। পাল্টা ইরান দেখিয়ে দিল– ইসরায়েলও হামলার নিশানার বাইরে থাকতে পারে না।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের এবারের আক্রমণ গুণ ও সংখ্যাগত দিক থেকেও আগের যে কোনো সরাসরি হামলার তুলনায় ভিন্ন ছিল। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ডেনিয়েল হাগরির মতে, হামলায় কমপক্ষে ১৭০টি ড্রোন, ৩০টি ক্রুজ ও ১২০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়া হয়েছিল। ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে।
বস্তুগত দিক থেকে ইসরায়েলি ঘাঁটিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল খুবই কম। হাগরি বলেছেন, ইরানের ছোড়া ৯৯ শতাংশ মিশন পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং মাত্র একজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রশ্নটি শুধু ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দিয়ে মীমাংসা হতে পারে না। এই হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা গেছে– ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার মতো নিজস্ব শক্তি ও সরঞ্জাম তেহরানের রয়েছে। জাতিসংঘের ইরানি মিশন যদিও অভিযান শেষ হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছে; ভবিষ্যতে যে আরও এ ধরনের হামলা ঘটবে না– সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।
জাতীয় নিরাপত্তা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমারও মনে হয়েছে, ইরানের হামলার উদ্দেশ্য ইসরায়েলের বস্তুগত ক্ষতি করা নয়। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আরও বিস্তৃত। দামেস্কের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইরান যদি হামলাটি বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিত, তাহলে ইসরায়েল ঘিরে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো চালিয়ে যাচ্ছে, তারা মনোবল হারিয়ে ফেলত। এ ছাড়া নিজের দেশের নাগরিকদের কাছেও শক্তি জানান দেওয়ার দরকার ছিল। হামলার মধ্য দিয়ে তেহরানের নেতারা এ বার্তাও দিতে চাচ্ছেন– যদি ইসরায়েল ইরানের স্বার্থের ওপর আবার আঘাত হানে, তাহলে তারা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে সক্ষম।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলার পর সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে? ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সাড়া দিচ্ছে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তা ছাড়া কয়েকটি নির্ধারকই বলে দেবে ইরান ও ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালাবে কিনা অথবা তারা ছায়াযুদ্ধে ফিরে যাবে কিনা।
এসব ফ্যাক্টরের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মনোভাব কী। ইতোমধ্যে গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করার চেষ্টাসহ নানা বিষয়ে নেতানিয়াহু চাপের মুখে রয়েছেন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামনেও রয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হচ্ছে।
ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও বিবেচনাযোগ্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, ইরানের সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দুই বছর ধরে ভিন্নমতকে কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। এর ফলে নাগরিকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ। ফলে ইসরায়েলের মতো ইরানও সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকির ব্যাপারটা ভেবে দেখবে। ইরান কিংবা ইসরায়েল কেউই একে অন্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় সামরিক লড়াই চালিয়ে সুনিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নেওয়ার অবস্থায় নেই।
এটা ঠিক, ইসরায়েলের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এ অঞ্চলে ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে বিমান কিংবা ভূপৃষ্ঠে হামলা চালানোর নিশ্চিতভাবে সক্ষমতা রাখে। যেহেতু তারা ইতোমধ্যে বহু বছর ধরে সিরিয়া ও লেবাননে তার প্রমাণ রেখেছে। হয়তো ইসরায়েল অল্প সময়ের জন্য সরাসরি ইরানেও একই ধরনের হামলা চালাতে পারে। কিন্তু ইসরায়েল ইরানে দীর্ঘ সময় ধরে সংঘবদ্ধভাবে টেকসই কোনো লড়াই চালিয়ে যেতে চাইলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কারণ ইরানের তুলনায় ইসরায়েলের বাহিনী আকারে ছোট।
দুই দেশের মধ্যকার ভৌগোলিক দূরত্বও গুরুতর বিষয়। জর্ডান ও মিসরের মতো আরব দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া ইরানে হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। সামনের দিনে এ ধরনের কোনো সমর্থন পাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
এসব বাস্তবতা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে আমার মনে হয়, ইরান নিজেদের গতানুগতিক যুদ্ধকৌশলে ফিরে গিয়ে মিত্রদের প্রতিরোধে সমর্থন দেবে। অন্যদিকে ইসরায়েল কিছু ‘প্রতীকী’ পাল্টা হামলা করতে পারে। দুই পক্ষই ছায়াযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে সরাসরি যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পরিস্থিতিতে নেই। বরং এটাও হতে পারে, সেই ছায়াযুদ্ধ আগের মতো হবে না। সরাসরি হামলা ও পাল্টা হামলার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যে দেখা যেতে পারে নতুন ধরনের ছায়াযুদ্ধ।
জাভেদ আলী: মিশিগান ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক; দ্য কনভারসেশন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম