ইমতিয়াজ আহমেদ
ইসরায়েলের প্রাণভোমরা পশ্চিমা বিশ্বে
প্রকাশ: ০১:০৬ পিএম, ১৮ এপ্রিল,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ১০:০৮ এএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ চালানোর পরপরই নেতানিয়াহু সরকার গাজায় গণহত্যা শুরু করেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি মনে করেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যে গাজাকে কাবু করে ফেলবেন।
কিন্তু দেখা গেল, এটা সম্ভব নয়; যদিও ইতোমধ্যে তারা ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করেছে। নিহত বেশির ভাগই শিশু ও নারী। এতে বিশ্বজনমত ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বেশ ক্ষেপে গেছে। এমনকি ইহুদিরাও তাদের বিপক্ষে বড় আকারে রাজপথে নেমেছে। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের ইহুদিরাও যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
গাজা যুদ্ধের শুরু থেকেই ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। ইসরায়েল সরকারের দাবি ছিল– ইরান হামাসকে নেপথ্যে থেকে মদদ দিচ্ছে। এ ছুতোয় গত ১ এপ্রিল ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে, যা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন। এতে ইরানের আল কুদস বাহিনীর সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট ১২ জন নিহত হয়েছেন।
এবারই প্রথম নয়; এর আগেও ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন অমান্যের নজির আছে। আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকা যে মামলা করেছিল, তার রায়ও ইসরায়েল উপেক্ষা করেছে। প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েল এই ঔদ্ধত্য দেখানোর ক্ষমতা পায় কোথা থেকে? মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনেই ইসরায়েল তা করতে পারছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বপরিসরে যে আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্বের কারণেই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তও অমান্য করার ঘটনা ঘটছে। অথচ এ সংস্থার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্র বাধ্য। কিছুদিন আগে নিরাপত্তা পরিষদে গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। তারাই আবার ঘোষণা দিল– এ ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার কোনো নিয়ম নেই। তার মানে, নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার ইসরায়েল রাষ্ট্রকে যেভাবে টিকিয়ে রাখতে চায়, যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই ক্রিয়া করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মনে করে, এ যুদ্ধে ইসরায়েলের পরাজয়ে তাদের নিজেদের বিরাট ক্ষতি। কারণ এর প্রভাব অন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা দেবে। উপরন্তু ইসরায়েলই বড় আকারের সর্বশেষ কলোনিয়াল সেটলমেন্ট বা বসতি স্থাপন; এখানকার অধিবাসীর বেশির ভাগই ইউরোপ, আমেরিকা থেকে এসে বসতি গেড়েছে। আমরা আগেও দেখেছি, সাম্রাজ্যবাদীরা অনেক জায়গায় পরাজিত হয়ে সরে গেছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা। এ দেশটিও দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের মতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। সে কারণে দেশটি আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করে।
অতীতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সমূলে উৎখাতের মাধ্যমে ইউরোপের এই কলোনিয়াল সেটলমেন্ট ঘটেছে। তবে এখন সময় পাল্টে গেছে। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে যেটা সম্ভব হয়েছিল, তা এখন সম্ভব নয়। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসব দেশ বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তারাই হরেক রকম আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে গণহত্যা ও জাতি নিধনের বিরুদ্ধে এবং আত্মরক্ষার পক্ষে আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। তারা হয়তো তখন বুঝতে পারেনি– এ কাঠামো তাদের বিপক্ষেই যাবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে অতীতের কিছু ঘটনা মাথায় রাখা দরকার। লেনিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল বাসিন্দাদের সঙ্গে ইহুদিদের দ্বন্দ্ব ছিল। এ কারণে লেনিন সে দেশে ইহুদিদের আলাদা বসতি করে দিয়েছিলেন। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে লেনিন এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখনও রাশিয়ায় ‘জুয়িশ অটোনমাস ওব্লাস্ট’ নামে জায়গাটি আছে। পরে তারা ইসরায়েলে বসতি স্থাপন করে। ইউরোপে জায়গা না দিয়ে ফিলিস্তিনে তাদের বসতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ইসরায়েলিরাই ফিলিস্তিনিদের ওপর সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল। এ কাজে যুক্তরাজ্যের বড় ধরনের মদদ ছিল, যার উপনিবেশ ছিল অঞ্চলটি। ১৯৪৮ সাল থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় ফিলিস্তিনে জাতি নিধনের চেষ্টা চলছে।
অসলো চুক্তির মধ্য দিয়ে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি নেতা ইতজাক রাবিনের মধ্যে এ চুক্তি হয়েছিল। বিরোধী পক্ষ দুই বছর পরই ইসরায়েলি নেতাকে হত্যা করে। তারাই বর্তমানে ইসরায়েলে ক্ষমতাসীন। দুই রাষ্ট্রের সমাধান ফিলিস্তিনিরা মেনে নেয়নি– এ কথাও ঠিক নয়। এক সময় কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ইসরায়েল ভেবেছিল, হামাসের মতো সংগঠন উঠে এলে তারা পিএলওর বিরুদ্ধে কথা বলবে। আর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি করে তারা নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে। এসব কর্মকাণ্ডে নেতানিয়াহুরও ভূমিকা ছিল। হামাস গঠনের প্রথমদিকে ইসরায়েল তাদের অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিল।
এরই মধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। ৭ অক্টোবর হামাস বড় আকারেই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এই অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যে সংখ্যায় ইসরায়েলিদের জিম্মি করা হয়েছে, সেটাও অকল্পনীয়। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসরায়েল প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ সংঘাত আরও বাড়াতে চেয়েছেন। এ জন্য তিনি ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়েছেন। গত ১৩ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলের বিভিন্ন ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে। ইরান প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। ইসরায়েল হামলা ঠেকাতে গিয়ে পুরোপুরি সফল– সেটাও বলা যায় না। যদিও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ডেনিয়েল হাগরি এমনটাই দাবি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ইরানকে প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা দিয়েছে। তবে ইরানের আক্রমণে একজনও মারা যায়নি। এটাই দুটো হামলার মধ্যকার সবচেয়ে বড় পার্থক্য। ইরান অসংখ্য মিসাইল নিক্ষেপ করেছে, অথচ একজনও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। সেটা বিবেচনায় নিলে অবশ্য ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে।
সামনের দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, বলা মুশকিল। তবে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ ইসরায়েলকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানাচ্ছে। তাতে মনে হয়, বড় কোনো যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা নেই। জো বাইডেন ইসরায়েলকে কী ধরনের সহায়তা দেবেন, সেটার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশ্বগণমাধ্যমের অবস্থানও মোটা দাগে ইসরায়েলের পক্ষে। অনেকের মতে, রাশিয়া ও চীন ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, শিগগির বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে না। ইসরায়েলও খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হচ্ছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়