প্রফেসর ড. মোঃ তোজাম্মেল হোসেন
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জন্মকথা
প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বিশ্ব বিধাতা কর্তৃক এক আশীর্বাদ। ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অসামান্য অবদান রেখে এ জাতির মণিকোঠায় যেমন করে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তেমনি দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর চরম বিদ্ধস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন্ন রাখার জন্য তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করার জন্য তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ব্যালটবাক্স ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম করে ছাত্র রাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। শহীদ জিয়া শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস দূরীকরণ, সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনা এবং ভবিষ্যৎ দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন ’বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। প্রতিষ্ঠার পর পরই জিয়ার আদর্শে গড়া ছাত্রদল এদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য নেতৃত্বে ছাত্রদল আশাতীত ভূমিকা রাখে এবং ৯০’র গণঅভ্যত্থানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান টার্গেট ছাত্রদল। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের চরম জুলুম-নিপীড়ন, গুম, হামলা-মামলা দিয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনটি অনেকটা পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। তারপরও বর্তমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের যোগ্য পরিচালনায় ছাত্রদল আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত আর দীর্ঘ ৯ মাসের অগ্নিঝরা ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শহীদ জিয়া মৃত্যুঝুঁঁকি নিয়ে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা এবং প্রাণপণ যুদ্ধ করে ও যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করে ছিনিয়ে আনেন বাংলার স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা। এরপর তিনি ব্যারাকে ফিরে যান; কিন্তু স্বাধীনতার নব সূর্যোদয়ের ঊষালগ্নেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শুরু হয় ক্ষমতার ভাগাভাগি ও শোষণ-নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭(ক) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে এদেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের মূল চেতনা গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতা হরণ করেন। জাতীয় ঐক্যের নামে বাকশালে যোগদান করার জন্য দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে বাধ্য করা হয়। মাত্র ৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সরকারের তত্ত্বাবধানে রেখে দেশের সকল পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। মুজিববাহিনী আর গণবাহিনীর অত্যাচারে জনজীবনে নেমে আসে চরম দূর্ভোগ। ব্যাংক ডাকাতি, লুটপাট, হইজ্যাক, শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক অস্ত্রবাজি এবং অস্ত্রের জোরে ডাকসু নির্বাচনের নামে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ছাত্র রাজনীতিকে স্মরণাতীত কালের কলঙ্কের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। দেশের এহেন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বার বার সেনা বিদ্রোহ ও পাল্টা বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে।
অতঃপর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের মাধমে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। প্রেসিডেন্টের দায়িক্তভার গ্রহণ করার পরই তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং রাষ্ট্রকে মেরামত করে একটি আধুনিক সুখী-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত¦ রক্ষা এবং দেশের সকল নাগরিককে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার জন্য তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের উন্নয়নে শরিক করার জন্য এবং ১৯ দফা বাস্তবায়নের জন্য ’বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ (বিএনপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলের আদর্শ বাস্তবায়ন, স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্র সমাজের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে শহীদ জিয়া এক ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (অবঃ) আসম মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়িত্ব প্রদান ও এ বিষয়ে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়।
দেশে নতুন একটি ছাত্র সংগঠন খোলার জন্য জনাব মোস্তাফিজুর রহমানের আহ্বানে ১ম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৬ অক্টোবর ১৯৭৮ সালে তাঁর গুলশানের বাসভবনে। এ সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কাজী আসাদুজ্জামান, কামরুজ্জামান খোকন, মাহমুদুর রহমান, এম. এ কামাল, মোহাম্মদ আলী টিপু, বজলুল করিম বাবুল, ওয়াসিমুদ্দিন, ডিউক চৌধূরী ও মনির চৌধূরী প্রমুখ। এ বৈঠকে ছাত্র সংগঠনটির নামকরণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে প্রস্তাবাকারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সংগঠনটির নাম হবে ’বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ এবং প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মহানগরীর ছাত্রদেরকে সুসংগঠিত করে ছাত্র সংগঠনটি গড়ে তোলার জন্য কাজী আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করা হয়।
সভায় গৃহীত খসড়া সিদ্ধান্তসমূহ বিএনপির চেয়ারম্যান শহীদ জিয়াকে জানানোর পর চূড়ান্ত হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রস্তাবিত ছাত্র সংগঠনটির রূপরেখা ও আদর্শ নিয়ে ১৯৭৮ সালের ৯ নভেম্বর বঙ্গভবনে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দায়িত্ব প্রদান করেন। জনাব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন কাজী আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে এনামুল করিম শহীদ, আকম গোলাম হোসেন, শরীফ শফিকুল হামিদ চন্দন, গোলাম সারোয়ার মিলন ও কাজী সগীর আহমদকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন।
জনাব চৌধুরী আহ্বায়ক কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অনুমোদনের জন্য জমা দেন। ১৯৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির ২৭ নম্বর ধানমন্ডিস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেন। ১৯৭১ সালের ২ জানুয়ারি দেশের সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত হয়। একই দিনে ছাত্রদলের উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয় তৎকালীন জনশক্তি মন্ত্রী জনাব এস. এ বারীকে। ছাত্রদলের মূলনীতি নির্ধারণ করা হয় শিক্ষা, ঐক্য ও প্রগতি। তাছাড়া উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এ সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এভাবেই শুরু হয়েছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পথযাত্রা।
নবগঠিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির ১ম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের মিলনায়তনে। ১ম ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায়। এ সভায় দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, উপ-পরিষদ গঠন, সাংগাঠনিক সফরের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে নজরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ২৬ জানুয়ারি জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা হাবিবুল্লাহকে আহ্বায়ক করে ঢাকা মহানগরী ছাত্রদলের কমিটি গঠিত হয়।
২৮ জানুয়ারি থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা শাখাসমূহ গঠন করার লক্ষ্যে টিম তৈরি করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও সকল জেলা পর্যায়ে সংগঠনের শাখাসমূহ গঠন করা হয়। ১৯৭৯ সালের মার্চে পুনরায় আ স ম মোস্তাফিজুর রহমানকে ছাত্রদলের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৯ সালের মে মাসে ঢাকা কৃষি কলেজ ছাত্র-ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত আলমগীর-শাহজাহান পরিষদ ভি.পি, জি.এসসহ পূর্ণ প্যানেল বিজয়ী হয়। ১৯৭৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত শহীদ-নজরুল পরিষদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ নির্বাচনে জসিমউদ্দীন হল ও রোকেয়া হলের জি.এস পদসহ কতিপয় পদে ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থীরা জয়লাভ করে।
১৯৭৯ সালের ১৫ জুন পুরাতন গণভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রদলের কনভেনশনে এনামুল করিম শহীদকে সভাপতি ও গোলাম হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০৫ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া এসময় ছাত্রদলকে দেখভাল করার দায়িত্ব প্রদান করেন বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। এনামুল করিম ও গোলাম হোসেন কমিটিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিলে তাদেরকে সংগঠনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে গোলাম সারোয়ার মিলনকে আহ্বায়ক করে নতুন কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ছাত্রদলের কার্যক্রম চলতে থাকে।
ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার পরপরই সংগঠনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং দেশের উন্নয়ন কাজেও সহায়তা করে যার ফলশ্রুতিতে অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্রদল একমাত্র আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংগঠন যে সংগঠনটি প্রচলিত ছাত্রসমাজের এন্টি গভর্নমেন্ট সেন্টিমেন্ট ধারার ঐতিহ্য ভেঙ্গে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন হয়েও ডাকসুতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসুতে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। তাই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল জাসদ ছাত্রলীগের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ে ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে ছাত্র রাজনীতিতে কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করে। ১৯৮১ সালের ডাকসু ও হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল ২টি ভি.পি এবং ৩টি জি.এসসহ মোট ২২টি পদে জয়লাভ করে। ১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচনে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। ডাকসু এ.জি.এসসহ ৪টি এবং ১১টি হল সংগঠনের মধ্যে ৭টি ভি.পি, ৮টি জি.এস, ৫টি এ.জি.এসসহ মোট ৬৫টি পদে জয়লাভ করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছাত্রদলের বিপুল জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের পেছনে কাজ করেছিল শহীদ জিয়ার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান বাড়ানো, ছাত্রদের শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা করা, মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠান করা প্রমুখ।
ছাত্রদলের ২য় সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ১৯৮১ সালের ৩০ মে; কিন্তু দেশী-বিদেশী কুচক্রীমহল ও আধিপত্যবাদী শক্তি জিয়ার আশাতীত সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এ দেশের গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। জিয়ার অবর্তমানে উচ্চভিলাষী সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচাপতি আব্দুস সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে। পরের দিনই এ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল করে। এটিই ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।
শহীদ জিয়ার অবর্তমানে ছাত্রদলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার অভিভাবকত্বে ছাত্রদল আবারও ঘুরে দাঁড়ায়। অবৈধ ক্ষমতা দখলদারী স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে হটানোর জন্য বিএনপির পাশাপাশি ছাত্রদলও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এরই মধ্যে ছাত্রদল দেশের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একক জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ডাকসুতে পূর্ণ প্যানেল এবং ১৪টি হলের ১২টিতেই ছাত্রদল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এ বিজয় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে আরো বেগবান করে।
১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর ডাকসুর নেতৃত্বে ছাত্র কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এ কনভেনশনে ডাকসু ভি.পি আমানুল্লাহ আমান স্বৈরাচার উৎখাতের ঘোষণা দেন। অতঃপর পুলিশের গুলিতে জেহাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ১০ অক্টোবর জেহাদের লাশকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ডাকসু ভি.পি আমানুল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় এরশাদ বিরোধী ‘সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য’। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত আন্দোলনের এক পর্যায়ে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। জনগণের শক্তির কাছে এরশাদ সরকার নতি স্বীকার করে ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের অবসান ঘটে। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোট পেয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
বর্তমান আওয়ামী সরকার গণতন্ত্রের মোড়কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করলেও বাকশালী কায়দায় দেশ শাসন করছে। রাষ্ট্রীয় প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। দেশের মানুষ বাক্স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার হারিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ডলার সংকট ইত্যাদি হাজারো সমস্যায় দেশের মানুষ আজ বড়ই অসস্তিকর অবস্থায় পড়েছে। বিরোধী দলকে দমানোর জন্য গুম, খুন, গায়েবি মামলাসহ ভয়াবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশের তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী, আপোসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে। এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে গণমানুষের দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি দেশনায়ক জনাব তারেক রহমান। তিনি বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটানোর জন্য বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন তথা ছাত্রদলকে ঢেলে সাজিয়েছেন। এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রদলের শত শত নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে, গুমের শিকার হতে হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এবং হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তারপরও এ সংগঠনের কার্যক্রম থেমে নেই। অভিষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই।
ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার পর অনেকেই মন্তব্য করেছিল যে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল স্বল্পায়ু হবে। দল ক্ষমতা হারালে ছাত্রদলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। সমালোচনাকারীদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে ছাত্রদল আজ শুধু বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ নয়; বরং এশিয়ার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিএনপির অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদসহ অঙ্গসংগঠনসমূহের প্রায় সকল পর্যায়েই ছাত্রদলের সাবেক নেতৃবৃন্দ দায়িত্ব পালন করছে। এ বৃহৎ ছাত্রসংগঠনকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারলে চলমান আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। ৯০’এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদল যেমন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল বর্তমান ছাত্রদলও তেমনি ভূমিকা রেখে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই হোক ছাত্রদলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অঙ্গীকার।
লেখক : প্রফেসর ডঃ মোহাঃ তোজাম্মেল হোসেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইউট্যাব ও সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।