লেখক প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান/খান মো. মনোয়ারুল ইসলাম
ভাটির দেশে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের দামে নৈরাজ্য এবং জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন!
প্রকাশ: ০৯:৪৮ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
নদীমাতৃক বাংলাদেশে হলো ভাটির দেশ। ঐতিহাসিকভাবে ভাটি অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে সপ্তদশ শতকে। ভাটির বারো ভূঁইয়ারা মোগল আধিপত্যের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। ভাটি অঞ্চলে শক্তিশালী নৌ বাহিনী গঠন করে মোগল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ইশা খান ও মুসা খানের নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়ারা। বারো ভূঁইয়াদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পঙে সুবাদার ইসলাম খানের সুনিপুণ রণ কৌশলে ১৬১০ সালে। ১৬০৯ সালে রাজমহল থেকে সুবাদার ইসলাম খানের মোঘল বাহিনী ভাটির বারো ভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে যে অভিযান পরিচালনা করেন সেটি সমাপ্ত হয় ১৬১০ সালে ঢাকা জয়ের মাধ্যমে। মোঘল বাহিনী ঢাকা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে একে রাজধানী ঘোষণা করে। রাজধানী ঢাকার যাত্রা তখনই। ঐতিহাসিক আব্দুল করিম ভাটির সীমানা নির্দেশ করেছেন-পশ্চিমে ইছামতি, দক্ষিণে গঙ্গা নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, উত্তর-পূর্ব সিলেটের বানিয়াচং, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এই বৃহৎ নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সিলেটের নিয়ে গঠিত। বিস্ময়করভাবে সপ্তদশ শতকের ভাটি অঞ্চলের পুরোটা নিয়েই বিংশ শতকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
ভাটি অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নদীগুলো জালের মত বিস্তার করে আছে সমগ্র ভূখন্ডকে। পানির সহজলভ্যতাই এ পাললিক ভূখন্ডকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই একবিংশ শতকে এসেও পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের চাইতেও প্রকৃতির অপার মহিমায় পানির সহজলভ্যতা এখানকার কৃষি অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনকে করেছে অনন্য।
পানির মূল্য বৃদ্ধিতে নৈরাজ্য : পানির সহজলভ্যতা বাংলাদেশে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনে স্বস্তির অনুষঙ্গ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো পানি এখন নাগরিক জীবনে আতঙ্কিত অনুষঙ্গ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিগত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাঙিয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও ঢাকা ওয়াসা দুই বছরে পানির দাম বাড়িয়েছে ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৫ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির পরে বিস্ময়করভাবে করোণা মহামারির মধ্যে ১ এপ্রিল ২০২০ পানির দাম ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন, ১৯৯৬(২২ এর ২ ধারা) অনুযায়ী প্রতিবছর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর বিধান থাকলেও করোণা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে আবার আগামী পহেলা জুলাই থেকে আরেক দফা পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই যুক্তি দেখান পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানো ছাঙা অন্য কোনো উপায় খুঁজে পান না বলেই দাম বাড়াতে হয়। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির ৬৫ শতাংশ গভীর নলকূপ ভূগর্ভস্থ বাকি ৩৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা। অর্থাৎ মোট পানির বেশিরভাগ অংশই পরিশোধনের প্রয়োজন হয় না। আবার নগরবাসী ওয়াসার কাছ থেকে যে পানি পায় সেটি প্রায় ক্ষেত্রেই পান উপযোগী নয়। টিআইবির তথ্য অনুসারে ঢাকা শহরে ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। এতে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়। এছাঙা খরচ সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয় সেটিও জনগণকে ধোঁকা দেয়া বৈ আর কিছুই নয়। ঢাকা ওয়াসার ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা তথ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ১৫৯২ কোটি টাকা। এতে পানির বিল ১২০১ কোটি টাকা বাকিটা সুয়ারেজ বিল বাবদ আয়। ট্যাক্সসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওয়াসার লাভ হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বছর শেষে ওয়াসার সঞ্চিত মুনাফার পরিমাণ দাঁঙিয়েছে ৮৯২ কোটি টাকা। সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লাভে থাকার পরও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জনগণের প্রতি চরম অবিচার।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমানে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বেতন ভাতা মাসে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তাকসিম এ খানের বেতন-ভাতা বেঙেছে ৪২১ শতাংশ। অথচ ঢাকা ওয়াসার এমডি পদটিতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দেয়া হলে বছরে অন্তত ৭০ লক্ষ টাকার সাশ্রয় হত। ঢাকা ওয়াসার এমডির বিগত বছরগুলোতে অর্জনটা কি? একই পদে ১৩ বছর দায়িত্ব পালনে জনগণ সুফল তো পাইনি বরং চৌদ্দবার পানির বর্ধিত দাম চুকিয়েছে ! অথচ কানাডার মতো দেশে বিগত ২০ বছরে পানির দাম এক টাকাও বৃদ্ধি পায়নি!
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য : যে তুঘলকী কান্ডের শেষ নেই : ভাটির দেশে পানির মূল্যের নৈরাজ্য সম্পর্কে বলা হলো, এবার সেবা খাতের আরও দুটি বঙ অনুষঙ্গ-গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিষয়ে আসা যাক। পানির মতই দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরো একদফা দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি চূঙান্ত পর্যায়ে। আগামী মার্চ মাসে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ওপরে গণশুনানির ঘোষণা এসেছে, এরপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়েও শুনানি হবে। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্য কাহিনী কি?
সিপিডির মতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রাক্কলনে সরকারের ত্রুটি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে চাহিদার বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ফলে চাহিদা না থাকায় সরকার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে না কিন্তু ভাঙার টাকা ঠিকই দিতে হচ্ছে গত এক দশকে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাঙা বাবদ সরকারের খরচ হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। পিডিবির সূত্র থেকে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎ কেষ্ক্রের শুধুমাত্র ভাঙা বছরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এই টাকাটা সরকারকে গুনতে হবে কোনো বিদ্যুৎ না কিনেই। আবার, ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারায় মাসে সরকারকে ভাঙা দিতে হচ্ছে ১৩০ কোটি টাকা। এই যে ভাঙাটা পরিশোধ করতে হচ্ছে এটি কিন্তু প্রতিবছর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিক্স ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাঙা বাবদ পিডিবির খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।
বিদ্যুৎ খাতের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুৎ সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য রাতারাতি টেন্ডার বিহীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্যের মাধ্যমে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রমগুলোকে নজিরবিহীন দায়মুক্তির ব্যবস্থাও করে সরকার।
সমালোচকরা বলেন “সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে লুটপাটের ব্যবস্থা করা” হয় বিদ্যুৎ খাতে। এই কুইক রেন্টালের দায় এখনো বিদ্যুৎ খাত বহন করছে। স্বল্প মেয়াদের ভাঙাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনো ৯২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এমন ১২টি স্বল্পমেয়াদী বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে। যেগুলোকে বসিয়ে রেখে সরকার শুধু ভাঙা দিয়ে যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ পর্যন্ত কিনছে না। এমন তুঘলকী কান্ড আধুনিক বিশ্বে কোথাও দেখা যাবে কি?
বিদ্যুতের মতই গ্যাস খাতে নৈরাজ্য অবর্ণনীয়। দেশে গত এক যুগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জোর না দিয়ে বিগত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চঙা দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতিরিক্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। পেট্রোবাংলার হিসাব মতে এ বছর মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৩ শতাংশ দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। এর জন্য পেট্রোবাংলার খরচ হবে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। আর বাকি ২৭ শতাংশ গ্যাস আসবে আমদানি থেকে যার জন্য খরচ হবে ৪৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা । চঙা দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতি আগ্রহ প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় ২০১৯ সাল থেকে দেশে প্রতিবছর গঙে ১০ লাখ টন করে এলএনজি সরবরাহ করছে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। ২০২০ সালে এ সরবরাহ আরো ১০ লাখ টন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানিটি। ওই সময়ে প্রস্তাবিত দর ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ৭ থেকে ১০ ডলার করে। বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ নিশ্চিতের পরিবর্তে স্পট থেকেই তাৎক্ষণিক মূল্যে এলএনজি সংগ্রহের পথ বেছে নেয় পেট্রোবাংলা। এটির ভয়াবহ ফলাফল প্রত্যক্ষ করছে দেশ। এই ফেব্রুয়ারিতেই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া থেকে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয় করার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে আরো বেশি দামে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে ভিটল এশিয়া থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্টে এলএনজি আমদানি করেছিল পেট্রোবাংলা।
ওমান ট্রেডিং অর্গানাইজেশন (ওটিআই)’র প্রস্তাব যথাসময়ে গ্রহণ করা হলে এলএনজি সংগ্রহে স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যেত। ইতিমধ্যে করোনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন সংকট স্পট মার্কেটকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এটাতে বোধহয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুব বেশি চিন্তিত নন কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন তাই স্পট মার্কেট থেকে অতি উচ্চ মূল্যে এলএনজি ক্রয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন।
পিডিবি ছাঙা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সব প্রতিষ্ঠান মুনাফায় আছে। ঘাটতি মোকাবিলায় প্রতিবছর ভর্তুকি পাচ্ছে পিডিবি। এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকেও ভর্তুকি দেয় সরকার। বিদ্যুৎখাতে ডিপিডিসির গত অর্থবছরের নিট মুনাফা ১০৮ কোটি টাকা। ডেসকোর নিট মুনাফা ৭৩ কোটি টাকা। পল্লী বিদ্যুতের নিট মুনাফা ২০ কোটি টাকা। ওজোপাডিকো নিট মুনাফা ২৪ কোটি টাকা। নেসকোর মুনাফা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। গ্যাস খাতে পেট্রোবাংলা গত অর্থবছরে মুনাফা করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। তিতাস মুনাফা করেছে ৩৪৬ কোটি টাকা। বাখরাবাদ ১২৬ কোটি, জালালাবাদ ২১৮ কোটি, কর্তফুলী ৩৫১ কোটি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ৬ কোটি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মুনাফা ৫৯ কোটি টাকা। এরকম মুনাফার রমরমা অবস্থা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় কার স্বার্থে? জনগণের স্বার্থে নয় নিশ্চয়ই। এটা পরিষ্কার, সরকারি সেবা খাত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো শোষণের পথ বেছে নিয়েছে।
নিত্যপণ্যের দামে বল্গাহীন গতি : পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের মতো সেবা খাতে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের যে পথ বেছে নিয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পঙেছে নিত্যপণ্যের বাজারে। ২০০৯ সালে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি এখন প্রতারণায় রূপ নিয়েছে। সরকারের অদক্ষতা ও অবহেলায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বল্গাহীন গতিতে। চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা, মুরগি, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অধিকাংশ সময়ে অযৌক্তিকভাবে বেঙে চলেছে। আরো বেঙেছে রান্নার গ্যাস, সাবান ও টুথ পেস্টের মতো নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য ও। সব মিলিয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে এমন একটি সময় যখন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস, পিপিআরসি ও সানেম) বলছে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ২১ শতাংশ থেকে বেঙে ৪২ শতাংশ এ পরিণত হয়েছে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসেবে ২০১৯ সালে ৫ লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল ৪৬৫-৫১০ যা ২০২২ সালে বেঙে ৭৪০-৭৮০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে তুলনায় এখন মোটা চালের দাম সাঙে ৩১, চিনি ১৯, মসুর ডাল ৩০, গুঁঙা দুধের দাম ১৩ শতাংশ বেঙেছে।
এবারের ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম কমেনি, সব ধরনের সবজির দাম ছিল বাড়তি। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের ভূমিকা ছিল নির্বিকার। সরকারিভাবে কম দামে চাল, ডাল, তেল, চিনি বিক্রির কার্যক্রমের পরিসর চাহিদার তুলনায় সীমিত রাখা হয়েছে। অথচ সরকারের চালসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের সামনে সীমিত আয়ের মানুষের ভিড় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন টিসিবির পণ্য কিনতে ভালো পোশাক পরা লোকের সমাগম বেড়েছে। বিগত এক বছরে সরকার চাল ও তেলের দাম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বাজারে জোর গুজব রয়েছে এসব সিন্ডিকেটের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের লোক জড়িত বলে এসব সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সরকার নির্বিকার।
বিগত এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর জন্য মার্চ মাসে গণশুনানি হবে। বিগত এক দশকে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে খুচরা দাম ৯০ শতাংশ বেড়েছে। এখন নতুন করে পাইকারি পর্যায়ে আরো ৬৪ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ৬৬ থেকে ৭৯ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। বিগত এক দশকে জ্বালানি তেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪৪ থেকে ৮০ টাকা।
আমরা ওপরে তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি সেবা খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত সব বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস কোম্পানি প্রতিবছরই মুনাফা করছে। প্রায় সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মতে, করোনা মহামারিতে সাধারণ জনগণের প্রকৃত আয় কমেছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তারপরও সরকার সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর। সরকার এখানে নিপীড়েকর ভূমিকায়। সরকারের এমন শোষকের ভূমিকা দেখলে খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও লজ্জা পেত!
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ “মুক্তি”র স্বপ্ন দেখেছিল। সেই মুক্তির স্বপ্নতেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে মানুষ এমন এক সময়ে যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ভোটাধিকার নাই বলে অথবা সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না বলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সরকারকে বিচলিত করে না। সেবা খাত সংশ্লিষ্ট সবগুলো সেক্টরে দাম বাড়ানোতে সরকারের ‘দ্বীধাহীনতা’য় জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন প্রলম্বিতই থেকে যাচ্ছে ।
লেখকঃ প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান/খান মো. মনোয়ারুল ইসলাম
morshedhk@yahoo.com