বাংলাদেশি চিকিৎসকের জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণা উৎসাহব্যঞ্জক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৪২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৩৭ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
জলাতঙ্ক (ইংরেজি নাম : Rabies) রোগটি হাইড্রোফোবিয়া নামেও পরিচিত। রেবিস নামক এক ধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস থেকে এই রোগ হয়। এই ভাইরাস সাধারণত গৃহপালিত ও বন্য প্রাণীদের প্রথমে সংক্রমিত করে। কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বাদুড়, নেউলে, বানর ইত্যাদি প্রাণী জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত প্রাণীটি সুস্থ মানুষ বা গবাদিপশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে এবং কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তির ৪০ শতাংশই হলো ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পূর্বে যথাযথ চিকিৎসা [পোস্ট এক্সপোজার প্রোফাইলেক্সিস (পিইপি), যার মধ্যে রয়েছে রেবিস ভ্যাকসিন এবং রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (আরআইজি)] প্রদান করা না হলে আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ নেই বললেই চলে। যদিও বর্তমানে রেবিসের কার্যকরী পিইপি বিদ্যমান আছে তারপরও বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতিবছর ৫৯ হাজারের বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যাচ্ছে। এই মৃত্যুর ৯০ শতাংশের বেশি এশিয়া এবং আফ্রিকার নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহে হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইউএইচও) দ্বারা প্রদত্ত নির্দেশিকা অনুসারে, তৃতীয় ক্যাটাগরির ইনজুরির (এক বা একাধিক কামড়সহ প্রাণীর নখের আঁচড় দ্বারা আক্রান্ত) ক্ষেত্রে রেবিস ভ্যাকসিনের সাথে আরআইজি’র প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু আরআইজি’র অত্যাধিক মূল্য এবং অপর্যাপ্ত সরবারহের জন্য বেশির ভাগ নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহে প্রচুর সংখ্যক তৃতীয় ক্যাটাগরির ইনজুরির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশিকা অনুসারে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জলাতঙ্কে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ সম্পর্কে মতামত জানতে চাওয়া হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. দায়েম উদ্দিন বলেন, জলাতঙ্ক রোগটি একটি ভয়াবহ রোগ। এশিয়া ও আফ্রিকার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এটি দেখা যায়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডা. শাকিল খান শাকিলের জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক খবর বটে। বিশেষ করে এটি ভাইরাল রিসার্চ হিসেবে বিশ^ পর্যায়ে বড় খবর। কারণ জলাতঙ্ক রোগের প্রকোপ বাংলাদেশে ভীতি ছড়ায়। এ নিয়ে বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হতে পারে কি না। এ সম্পর্কে ডা. দায়েম আরো বলেন, এটি হতেই পারে। বর্তমানে রাজশাহীস্থ বারিন্দ মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. দায়েম উদ্দিন আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও এবং এফডিএ’র মতামত প্রয়োজন পড়বে।
এমতাবস্থায় আরআইজি’র কার্যকরী বিকল্পের খোঁজে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণা করে যাচ্ছেন। এমনই একটি গবেষণার ফল সম্প্রতি বিখ্যাত “এন্টিভাইরাল রিসার্চ” নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। গবেষণা কাজটি সম্পন্ন হয়েছে জাপানের ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, ফেভিপিরাভির (যা এভিগান নামেও পরিচিত) নামক এন্টিভাইরাল ড্রাগটি মুখে খাইয়ে কিংবা ক্ষত স্থানে অয়েন্টমেন্ট হিসাবে লাগিয়ে আরআইজি’র বিকল্প হিসেবে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ব্যবহার করলে ১০০ ভাগ ইঁদুর জলাতঙ্ক রোগের মৃত্যু থেকে রক্ষা পাচ্ছে। পাশাপাশি ফেভিপিরাভির প্রাপ্ত ইঁদুর আরআইজি প্রাপ্ত ইঁদুরের তুলনায় অনেক বেশি ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি করছে যা রেবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির ইঙ্গিত বহন করে। গবেষণায় প্রাপ্ত এ ফলাফলকে ‘অত্যন্ত চমকপ্রদ’ বলে মন্তব্য করেন গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আকিরা নিশিজুনো। অধ্যাপক নিশিজুনো উল্লেখ করেন যে, ফেভিপিরাভির আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস বা এফডিএ অনুমোদিত একটি ওষুধ যা বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে এবং মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই ফেভিপিরাভির ওষুধটির সেফটি মানুষের শরীরে নতুন করে পরীক্ষার দরকার হবে না। এখন প্রয়য়োজন শুধু জলাতঙ্ক রোগের ক্ষেত্রে যথাযথ ক্লিনিক্যাল স্টাডি সম্পন্ন করে ইঁদুরে প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা। গবেষণাটির অন্যতম লিড গবেষক এবং ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ফ্যাকাল্টি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. শাকিরুল খান শাকিল বলেন, আমাদের গবেষণার ফলটি জলাতঙ্কের চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত। এতদিন পর্যন্ত প্রচলিত ধারণা ছিল যে, রেবিস ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রে (স্পাইনাল কর্ড কিংবা মস্তিষ্কে) প্রবেশ করলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ নেই বললেই চলে। কিন্তু আমরা জীবন্ত ইঁদুরে রেবিস ভাইরাসের মুভমেন্ট ট্র্যাকিং করে দেখতে পেয়েছি যে, রেবিস ভাইরাস স্পাইনাল কর্ড কিংবা মস্তিষ্কে প্রবেশ করার পরও যে সমস্ত ইঁদুরকে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ফেভিপিরাভির দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে সেই ইঁদুরগুলো জলাতঙ্ক রোগ থেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।
ড. শাকিল মনে করেন, ফেভিপিরাভির এমন একটি এন্টি ভাইরাল ড্রাগ যেটি রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (আরআইজি)-এর কার্যকরী বিকল্প হিসাবে রেবিস ভ্যাকসিনের সঙ্গে ব্যবহার করে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হতে পারে। তবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে উল্লেখ করেন যে, আমাদের গবেষণার ফলাফল ইঁদুরের ওপর পরীক্ষিত যা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা তা এখনো যথাযথ ক্লিনিক্যাল স্টাডি দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। এমতাবস্থায় ক্লিনিক্যাল স্টাডির ফলাফল পাবার পূর্বে কেউ যেন নিজ উদ্যোগে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসায় ফেভিপিরাভির ব্যবহার না করেন।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর ৫ লক্ষের বেশি মানুষ সন্দেহজনক রেবিস ভাইরাস বহনকারী প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা নিতে আসেন। এতো পর্যাপ্ত সংখ্যক রোগীকে ব্যয়বহুল এবং অপ্রতুল আরআইজি দিয়ে চিকিৎসা দেয়া বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে সন্দেহজনক রেবিস ভাইরাস বহনকারী প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সেখানে যথাসময়ে আরআইজি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলশ্রুতিতে প্রচুর সন্দেহজনক জলাতঙ্ক রোগী যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন। একই ধরনের চিত্র এশিয়া এবং আফ্রিকার অন্যান্য জলাতঙ্কপ্রবণ দেশেও দেখা যায়। এমতাবস্থায়, তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা ফেভিপিরাভির যা সহজে প্রাপ্য ও কোনো প্রকার টেকনিক্যাল সাপোর্ট ছাড়াই প্রয়োগ করা যায় এবং বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসায় আসলেই আশার আলো দেখাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এক্ষত্রে একটি কার্যকরী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের চিকিৎসায় “নাসভ্যাক” নামক নতুন ওষুদের উদ্ভাবক ড. শেখ মোঃ ফজলে আকবর।
এদিকে গবেষণাটির অন্যতম লিড গবেষক এবং ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের ফ্যাকাল্টি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. শাকিরুল খান শাকিল বলেন, তারা বাংলাদেশে মানবদেহে একটি কার্যকরী ক্লিনিক্যাল স্টাডি করতে চান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ফেভিপিরাভির ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা আশানুরূপ সহযোগিতা করবেন বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
এ সম্পর্কে মতামত জানতে চাওয়া হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. দায়েম উদ্দিন বলেন, জলাতঙ্ক রোগটি একটি ভয়াবহ রোগ। এশিয়া ও আফ্রিকার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এটি দেখা যায়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডা. শাকিল খান শাকিলের জলাতঙ্ক নিয়ে গবেষণার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক খবর বটে। বিশেষ করে এটি ভাইরাল রিসার্চ হিসেবে বিশ^ পর্যায়ে বড় খবর। কারণ জলাতঙ্ক রোগের প্রকোপ বাংলাদেশে ভীতি ছড়ায়। এ নিয়ে বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হতে পারে কি না। এ সম্পর্কে ডা. দায়েম আরো বলেন, এটি হতেই পারে। বর্তমানে রাজশাহীস্থ বারিন্দ মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. দায়েম উদ্দিন আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও এবং এফডিএ’র মতামত প্রয়োজন পড়বে।