মৃত্যুফাঁদের শহর ঢাকা অপঘাতে বাড়ছে মৃত্যু
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০৪ পিএম, ৪ মার্চ,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:৫৭ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
নানা ধরনের অপঘাতে মৃত্যু বাড়ছে রাজধানী শহর ঢাকায়। প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস এই শহরে। পদে পদে যেন পাতা রয়েছে মৃত্যুফাঁদ। ঢাকায় প্রায়ই আগুনে পুড়ে মারা যায় মানুষ। কখনো কখনো ভবনে ঘটে বিস্ফোরণ। গ্যাসলাইন, সুয়ারেজ লাইন, ওয়াসার পানির লাইনসহ সব লাইনই যেন বিস্ফোরণোন্মুখ। বিস্ফোরণ হচ্ছে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারেও। এর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনা, নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ইট পড়া তো আছেই। আয়তন অনুপাতে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকরা সব সময় কাজ করেন কার্যত প্রাণটা হাতে নিয়ে। উঁচু ভবন থেকে পা ফসকে পড়ে কত শ্রমিক মারা যাচ্ছেন।
বছর জুড়ে দূষিত বায়ুর শহরের শীর্ষে ছিল ঢাকার অবস্থান। একটু বৃষ্টিতেই জলবন্দি, সেই জল বিদ্যুতায়িত হলে হয়ে যায় মৃত্যুফাঁদ। কখনো গাছের মরা ডাল ভেঙে পড়ে পথচারীর মাথায়। একটু অসতর্কতায় ঢাকনা খোলা ম্যানহোলেও প্রাণ যায় অনেকের। রেলক্রসিংয়ে ট্রেন ধাক্কা দিচ্ছে যানবাহনকে। কখনো মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গাডার ধসে মৃত্যু হচ্ছে কত শত মানুষের।
সর্বশেষ বেইলী রোডে অপ্রত্যাশিত আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৪৬ জন। এর আগে খুলনার মেয়ে দীপু সানা বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখার সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১০ জানুয়ারি বিকেলে কর্মস্থল থেকে অফিসের বাসে রওনা দিয়ে শান্তিনগরে নামেন। এরপর হেঁটে মগবাজারের গাবতলার বাসায় ফিরছিলেন। মৌচাক উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে হেঁটে আসার সময় ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্টের পাশে ওপর থেকে ইট পড়ে তার মাথার ওপর। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। দীপুর মৃত্যুর ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেছেন তার স্বামী প্রকৌশলী তরুণ কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ইটটা কোথা থেকে এসেছে, তা এখনো পুলিশ শনাক্ত করতে পারেনি। আমরা পুলিশের দিকে তাকিয়ে আছি। এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো তথ্যই দিতে পারেনি। ওপর থেকে ইট পড়ে মৃত্যু এটাই প্রথম নয়। ২০২২ সালের ৩০ মে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে মেট্রোরেল স্টেশনের ওপর থেকে ইট পড়ে সোহেল তালুকদার নামের এক জুয়েলারি কর্মীর মৃত্যু হয়।
এমন মৃত্যু সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সরকারের বিভিন্ন জায়গায় অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনা বলতে গেলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা শহরে কত ধরনের কর্তৃপক্ষ আছে। কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করছে না। তিতাস, রাজউক, ওয়াসা, পুলিশ, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর যাদের যা দায়িত্ব, তারা তা পালন করছে না। সবাই ব্যস্ত নতুন নতুন প্রকল্প নিতে। কারণ সেখানে আছে টাকা। দরদ দিয়ে যে বিষয়গুলো দেখভালের কথা, সেটা কেউ করছে না।
রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার চাপায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয় ২০২২ সালের আগস্টে। বউভাত খেয়ে প্রাইভেট কারে নবদম্পতিকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন স্বজনরা। উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়সংলগ্ন সড়কে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে তাদের মৃত্যু হয়। প্রাইভেট কারে সাত আরোহীর মধ্যে শুধু বেঁচে যান বর হৃদয় (২৬) ও নববধূ রিয়া মনি (২১)। প্রাইভেটকারে ছিলেন হৃদয়ের বাবা রুবেল (৬০), হৃদয়ের শাশুড়ি ফাহিমা (৪০), রিয়া মনির খালা ঝরনা (২৮), ঝরনার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটা মামলা হয়।
মামলার বাদী নববধূ রিয়া মণির মামা মো. আফরান মণ্ডল বাবু বলেন, ঘটনার পরপর বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ব্যাপক তোড়জোড় ছিল। তাৎক্ষনিকভাবে নিহত প্রত্যেককে ২০ লাখ করে টাকা দিয়েছে তারা। কয়েক দিনের মধ্যে প্রত্যেকের জন্য ৩ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় বিআরটি কর্মকর্তারা। কিন্তু দিন যত গেছে, তারা দূরে সরে গেছেন। এখন আর ফোনও ধরেন না। আমরা চেষ্টা করেও তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না।
গত বছর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে মার্কেটে অবৈধ গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে জীবন যায় ২৪ জনের। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে সুয়ারেজ লাইনের গ্যাস থেকে। সেখানেও নিহত হন পাঁচ জন। মগবাজারে ভবন বিস্ফোরণে মারা যান কয়েক জন। রাজধানীর সড়কগুলোতে দেখা যায় বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইনের খুঁটির সঙ্গে নানা ধরনের তারের জঞ্জাল। প্রায়ই এসব তারের জঞ্জাল থেকে আগুন ধরে যায়। আর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনা তো ঘটছেই। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের প্রায় ২৯ ভাগ মারা গেছেন শুধু ঢাকা শহরে।
ঢাকা শহরে এত বেশি দুর্ঘটনার কী কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, এখানে যে শুধু গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে এমন নয়। রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। অল্প জায়গায় বেশি যানবাহন চলছে। আর অনেকেই আইনের তোয়াক্কা করছে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনিয়ম আর দুর্নীতি এর জন্য প্রধানত দায়ী। কেউ দায়িত্ব নিয়ে শহরটাকে গোছানোর চেষ্টা করে না। সবাই চেষ্টা করে কীভাবে টাকা কামানো যায়। ফলে দিন দিন শহরটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
বায়ুদূষণে ঢাকা প্রায়ই পৃথিবীর শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর এমন মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো যানবাহনের ধোঁয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ এবং মেরামতের কারণে সৃষ্ট ধূলিকণা। ঢাকার বাতাসে এখন লেড ও মার্কারির মতো হেভি মেটালের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে গবেষণায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মিরপুরে ঢাকা কমার্স কলেজসংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তি এলাকার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়ে। হেঁটে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চার জন মারা যান। তাদের মধ্যে এক শিশু, এক নারী ও দুই জন পুরুষ ছিল। ঐ ঘটনায় মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলাটির তদন্ত করছেন এসআই লেসলন। তিনি বলেন, এই ঘটনার পর বেঁচে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যরা ময়মনসিংহে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। আমি নিজেও তাদের খোঁজার চেষ্টা করছি। মামলার তদন্ত খুব বেশি এগোয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭০৯ জন। এর মধ্যে পরিবহন সেক্টরে ২৪৬ জন, নির্মাণ শ্রমিক ১১৩ জন, কৃষি শ্রমিক ৯৭ জন, রিকশা শ্রমিক ৪৪ জন, দিনমজুর ২৯ জনের নানাভাবে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সারা দেশের কোথাও নিহতরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।
ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সম্পাদক শাকিল আক্তার চৌধুরী বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। ফলে যে যার মতো অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। একটা নির্মাণাধীন ভবনে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেটা কিন্তু আইনে বলা আছে, কিন্তু নেওয়া হচ্ছে না। ফলে যে যার মতো কাজ করছে। এখানে মূলত সমন্বিত একটা পরিকল্পনা দরকার। ঢাকা শহর দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা টাক্সফোর্স থাকলে তারা এটা দেখতে পারত। সবাই যে যার মতো কাজ করছে, কিন্তু মূল কাজটিই হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।