স্বপ্নের লন্ডন এখন দুঃস্বপ্ন হাজারো বাংলাদেশির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:০৯ পিএম, ৪ মার্চ,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:১৬ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
স্বপ্নের লন্ডনে এসেছিলেন বুক ভরা আশা নিয়ে। নিজের সচ্ছলতার পাশাপাশি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবেন। তবে সেই স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে গেল। জীবনে নেমে আসলো অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। এই অন্ধকারে দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না লন্ডনে পাড়ি জমানো হাজার হাজার বাংলাদেশি। গত তিন বছরে কেয়ার, স্টুডেন্ট এবং ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় ব্রিটেনে পাড়ি জমানো হাজারো বাংলাদেশি এখন একটি কাজের আশায় হন্য হয়ে এই দুয়ার থেকে ওই দুয়ারে ঘুরছেন। আর তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট মালিক। দিনে ৮-১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করিয়ে সপ্তাহে দিচ্ছেন নামমাত্র মজুরী।
লন্ডনের বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করেন হামিম আহমদ (ছদ্মনাম)। তিনি কেয়ার ভিসায় প্রায় ২৯ লাখ টাকা খরচ করে ব্রিটেনে এসেছেন। আসার পর প্রায় ৬ মাস ধরে কাজ খুঁজলেও কোন কাজ জোগাড় করতে পারেননি। পরে একটি রেস্টুরেন্টে কিচেন পর্টার হিসাবে কাজ পান। থাকা খাওয়া ফ্রি ও সপ্তাহে একদিন ছুটি এমন শর্তে কাজে যোগ দেন হামিম। বেতন সপ্তাহে ১২০ পাউন্ড। এর বেশি দিবেন না মালিক। পরে কোন উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য হয়ে ১২০ পাউন্ড বেতনে কাজ করেন তিনি। কিন্তু কাজে যোগদানের পর তাকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করাতে শুরু করেন রেস্টুরেন্টের মালিক। শুক্রবার ও শনিবারে ১২-১৩ ঘণ্টা এবং অন্যান্য দিনে ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় হামিমকে।
হামিম বলেন, ‘ব্রিটেনে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দেশে সরকারি চাকরি ছেড়ে এসেছি। আর এখানে এসে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।’
হামিমের মতো জামিলেরও (ছদ্মনাম) একই অবস্থা। প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা খরচ করে ব্রিটেনে এসেছেন। তিনিও একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কিচেন পর্টার হিসাবে কাজ করেন। বেতন পান সপ্তাহে ২০০ পাউন্ড। প্রতিদিন তাকে গড়ে ৯ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেই হিসেবে ঘণ্টা প্রতি ৩.৭০ পাউন্ড বেতন পান তিনি। লন্ডনে যেখানে ঘণ্টায় সর্বনিম্ন মজুরী ১১ পাউন্ড ৪৫ পয়সা সেখানে রেস্টুরেন্ট মালিক তাকে এর মজুরীর ৩ ভাগের এক ভাগও দিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এই দেশে এসেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি এমন স্বপ্ন চারা গজানোর আগে পিষে মেরে ফেলা উচিত ছিল। পুরো পরিবার আমার দিকে তাকিয়ে। শুধু পরিবার নয়, অধিকাংশ আত্মীয় স্বজনও আমার দিকে তাকিয়ে। তারা মনে করেছেন আমি এখানে টাকা কুড়াচ্ছি। কিন্তু আমি যে কী কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি তারা তা আন্দাজও করতে পারছেন না। দিনরাত পরিশ্রমের পর এমন অল্প কিছু পাউন্ড হাতে পাওয়ার পর নিজেকে খুব অসহায় লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। মালিককে বেতন বাড়ানোর কথা বললে তিনি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। কাজ হারানোর ভয়ে চুপ থাকি।’
শুধু হামিম কিংবা জামিল নয়। বর্তমানে ব্রিটেনে হাজার হাজার মানুষ এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। নামমাত্র মজুরিতে গাধার খাটুনি খেটে যাচ্ছেন মাসের পর মাস। কাজ হারানোর ভয়ে মুখ বুঝে সব সহ্যও করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি কমিউনিটির ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কাজের জন্য হাহাকার। একটি ভালো বেতনের কাজের আশায় চেনা-পরিচিত পর্যায়ে যোগাযোগ করেও মিলছে না কাজ। হাজারো বাংলাদেশি দেশ থেকে আসার পরও মাসের পর মাস বেকার। বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি কমিউনিটিতে অবস্থা প্রায় একই।
এ বিষয়ে ইউকে-বাংলা প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি মুনজের আহমদ চৌধুরী বলেন, কেয়ার এবং স্টুডেন্ট ভিসায় যারাই ইউকে এসেছেন তাদের বেশিরভাগেরই কাজ নেই। আর এই সুযোগ নিচ্ছেন বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট মালিকেরা। থাকা খাওয়া ফ্রি এমন শর্তে নামমাত্র বেতন দিচ্ছেন। এটা অমানবিক।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ‘ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লন্ডন শাখা'র প্রেসিডেন্ট মনির আহমেদ বলেন, ‘একজন ওয়ার্কারকে দিয়ে পূর্ণ কাজ করিয়ে তাকে নামমাত্র মজুরি দেওয়া এটা অমানবিক, শুধু অমানবিক নয় রীতিমতো ডাকাতি। আমাদের কমিউনিটির রেস্টুরেন্ট মালিকদের মধ্যে যারা এটি করছেন আমি বলব তারা অনৈতিক কাজ করছেন। কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া ঠিক না। একজন মানুষকে এদেশের মিনিমাম মজুরী না দেন অন্তত ৫০-৬০ ভাগ মজুরি দেন। এতে সে অন্তত কিছুটা সচ্ছল ভাবে চলাফেরা করতে পারবে।’
মূল সংবাদ ঃ দেশ রূপান্তর ।