বিএনপি নেতাদের মুখে কারাবাসের অভিজ্ঞতা, কারাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০৩ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:০৫ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
সম্প্রতি কারাবাসের পর জামিনে মুক্ত বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, তারা কারাগারে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। ৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পরদিন রাতে গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে নেওয়া ও থাকা পর্যন্ত তাদের ওপর মারাত্মক ‘মানসিক নির্যাতন’ ও কারাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হচ্ছে।
তাদের ভাষ্য, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস, মো. আব্দুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, শিমুল বিশ্বাসসহ অনেকের সঙ্গে যে ধরনের ‘অসদাচরণ’ করা হয়েছে, তা কল্পনাতীত। এ ধরনের নির্যাতন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল এবং যে আচরণ করা হয়েছে, তাকে ‘আবু গারিব’ কারাগারের সংস্করণ বলে দাবি তাদের।
গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে ঘিরে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়া নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অনেকে আহত হন, মারা যান একজন। ওই দিনই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সাড়ে চার শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করা হয়।
সেদিন গ্রেপ্তার হওয়াদের অন্যতম—ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক মো. আবদুস সালাম, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, এবিএম মোশারফ হোসেন, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, সেলিম রেজা হাবিব ও খন্দকার আবু আশফাক।
এরপর ৮ ডিসেম্বর রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরদিন তাদের পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও রমনা থানায় পুলিশের চারটি মামলায় প্রায় ৩ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ৭২৫ জনের নাম মামলার এজাহারে থাকলেও মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের নাম ছিল না। এক মাস কারাভোগের পর গত ৯ জানুয়ারি তারা দুজন মুক্তি পান। এ ছাড়া রুহুল কবির রিজভী বাদে সম্প্রতি অন্য সবাই কারামুক্ত হয়েছেন।
বিএনপির কারামুক্ত নেতারা জানান, ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে প্রথমে তাদের বিভিন্ন থানার গারদ ও ডিবি কার্যালয়ের একটি রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয়। পরদিন কারাগারে নেওয়ার পর কোয়ারেন্টাইনে রাখার নামে ‘প্রতারণা’ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সেলে (কনডেম সেল) রাখা হয় শীর্ষ নেতাদের। কনডেম সেলের ভেতরের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেওয়া হয়। এমনকি মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের মতো সিনিয়র ও বয়স্ক নেতাকেও একই অবস্থায় রাখা হয়।
বিএনপির এসব শীর্ষ নেতা অভিযোগ করেন, শুধু তাই নয়, তাদের খাবারের কষ্ট দেওয়া হয়। এমনকি স্বাভাবিক হাঁটাচলাও করতে দেওয়া হয়নি। এক কথায়, সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও নেতাদের সঙ্গে যে ধরনের অমানবিক ও অসদাচরণ করা হয়েছে, তা অতীতের চেয়ে তিক্ত। এ ছাড়া ৭ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে অনেক স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের এক পোশাকেই সাত দিন এক রুমে রাখা হয়েছিল।
কারাবাসের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতি করলে কারাগারে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত অনেকবার কারাগারে গেছি; কিন্তু এবার অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত লক্ষ করলাম, সাবেক মন্ত্রী-এমপি হিসেবে আমি ও মির্জা আব্বাস ডিভিশন প্রাপ্য হলেও প্রথম পাঁচ দিন ডিভিশন দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ সঠিক কোনো উত্তরও দিতে পারেনি। আমাদের পরিবারের সদস্যরা যখন আদালতে রিট করতে যাচ্ছিল, তখন ডিভিশন দেয়।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এবারের জেলজীবন অত্যন্ত নিষ্ঠুর...। আমরা দেখেছি জেলখানায় আমাদের হাজারো ছেলে বন্দি আছে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা করতে পারব না। তারা কী অবস্থায় আছে এক আল্লাহ মাবুদ জানেন। যদিও এই সরকারের কাছে আশা করাটা খুব মুশকিল। তার পরও বলব, আপনারা এই কারাবন্দিদের প্রতি দয়া করে একটু বিবেকবান হবেন। এরা বন্দি নন, এরা চোর বা ডাকাত নয়। এরা সব রাজনৈতিক কর্মী এবং দেশের মানুষের কথা বলে বলে আজকে কারাগারে। একটু দেখে যান তারা কেমন আছে? একটি জেলখানার মধ্যে তারা কেমন করে থাকে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, অতীতের চেয়ে এবার কারাগারের ভেতরে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হয় সবচেয়ে বেশি। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যেরকম অমানবিক ও অসদাচরণ করা হয়েছে, তা অতীতের সব ঐতিহ্যকে ম্লান করেছে। দেশ যে ফ্যাসিবাদী কায়দায় চলছে, কারাগারের ভেতরে সংশ্লিষ্টদের আচরণে সেটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। এটি শুধু কারাবিধির লঙ্ঘনই নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। আসলে পুলিশ ও জেলখানা এখন একই নির্দেশে চলছে।
কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছি; কিন্তু এবার কারাগারে যেভাবে আচরণ করা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতারা কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন পাওয়ার কথা; কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাদের কনডেম সেলের লকআপে ১৫ দিন রাখা হয়। আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকেও একই জায়গায় রাখা হয়েছিল। এভাবে আমাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন করা হয়েছে। অন্য সবার সঙ্গে কারাগারে যেভাবে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
তিনি বলেন, কারাগারে নেওয়ার পর আমাদের সমস্ত মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ন্যূনতম সৌজন্য দেখানো হয়নি। মনে হয়, আমরা যেন সমাজের সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত মানুষ। এমন জায়গায় রাখা হয়েছিল, যেখানে চেয়ার-টেবিল, বিছানা, মশারি কিছুই নেই। অথচ কনকনে শীতের রাতে মাটিতে ঘুমাতে হয়েছে। বারবার এগুলো বলার পরও জেল সুপার ও জেলার অপারগতা জানিয়ে বলেন, তারা ওপরের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতে পারেন না।
খোকন আরও বলেন, আমাদের অন্য প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। অনেককে একটি পোশাকেই সাত দিন লকআপে রাখা হয়েছিল। এটি শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা না, এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, জেল তো জেলই। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির কারণে বহুবার জেলে গেছি। ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে এবং স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে কারাগারে গেছি; কিন্তু তখন মর্যাদা পেয়েছি। এক রুমে দুই বা তিনজন থাকতাম। রাজবন্দির মতোই ছিলাম। এরপর ২০০১ ও ২০০৮ সালে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। এই সরকারের আমলে ২০১১, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও কারাগারে গেছি। সে সময় সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিভিশন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো; কিন্তু এবার যা করা হয়েছে, তা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, বাইরে থেকে কোনো জিনিসও নিতে দেয়নি। এসবই যেন পূর্বপরিকল্পিত।
তিনি বলেন, এবার কারাগারে ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা হলো—৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পর ডিবি কার্যালয়ে একসঙ্গে ১৬ জনকে গাদাগাদি করে নির্ঘুম থাকতে হয়েছে। সেখানে মাত্র ১টি বাথরুম। এখান থেকেই নির্যাতনের শুরু। এরপর আদালতে নিয়ে ১০ জনকে প্রিজনভ্যানে রাখা হয় ২ ঘণ্টা। সন্ধ্যায় কারাগারে নিয়ে সেখানেও দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়েছে। অনেক সিনিয়র নেতা একসঙ্গে ছিলাম। জেলার বা জেল সুপার কেউ আসেনি। অনেকেই ডিভিশন প্রাপ্য হলেও দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে কোয়ারেন্টাইনের কথা বলে নেওয়া হয় ‘সূর্যমুখী’ সেলে। যেখানে বড় অক্ষরে ‘মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত’ লেখা রয়েছে। সেখানে একেকজনকে দেওয়া হয় দুটি কম্বল, ১টি বালিশ, ১টি প্লেট, ১টি গ্লাস। রাতের খাবার ছিল রুটি ও ভাজি, যা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ডিভিশন প্রাপ্য ব্যক্তির সঙ্গে যায় না। শুধু তাই নয়, সেলের পেছনে রাখা ছিল ৩টি লাল রঙের পানির বোতল। মানে হচ্ছে—‘রেড জোন’। কারারক্ষীরা বলে, স্যার এর বাইরে যাওয়া নিষেধ। এরপর ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস কারাগারে তাদের সঙ্গেও একই আচরণ করা হয়। ওইদিন জেল সুপার এসে বলেন, এর বেশি কিছু করার সুযোগ তাদের নেই। ৬ দিন পর মির্জা ফখরুল ও আব্বাস এবং অন্যদের ১২ থেকে ১৫ দিন পর ডিভিশন দেওয়া হয়।
একই রকম তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান বিএনপির সদ্য কারামুক্ত কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবদুস সালাম, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, সেলিম রেজা হাবিব, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবসহ অনেকেই।
বিএনপি নেতাদের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, কে কী অভিযোগ করল সেটি বিষয় নয়। আমরা কারাবিধি মোতাবেক যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তাই করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিভিশন তো দেবেন আদালত ও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের আদেশ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। এ ছাড়া সিনিয়র নেতাদের কনডেম সেলে রাখার বিষয়টি সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন সুভাষ কুমার ঘোষ।