জয়পুরহাটে দিনে ১০ তালাক : এগিয়ে নারীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০৩ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৫১ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
জয়পুরহাটে কমছে না তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ। গত এক বছরের প্রত্যেক দিনে গড়ে ১৪টি বিবাহ নিবন্ধিত হলেও দিনে ১০টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ বিবাহের তুলনায় ৭১ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটেছে। তালাক দিতে এগিয়ে আছেন নারীরা। বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে মুঠোফোনে পরকীয়া, সন্দেহ, মানসিক অবসাদ, যৌতুক, দাম্পত্য কলহসহ নানামুখী চাপের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এবং যোগাযোগ কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলার পাঁচটি উপজেলায় মোট ৫ হাজার ২৬০টি বিবাহ নিবন্ধিত হয়েছে। একই সময়ে আবার ৩ হাজার ৭৩৬টি তালাক হয়েছে। এর মধ্যে ছেলের পক্ষ থেকে তালাক ৭৭৩টি, মেয়ের পক্ষ থেকে তালাক এক হাজার ৪৭১টি এবং উভয়পক্ষ আপস রফায় তালাক হয়েছে এক হাজার ৪৯২টি। অর্থাৎ ছেলেপক্ষ থেকে তালাকের প্রায় দ্বিগুণ তালাক হয়েছে মেয়ের পক্ষ থেকে। জয়পুরহাট জেলায় ৩২টি ইউনিয়ন পরিষদ ও পাঁচটি পৌরসভা রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভাগুলোতে নিকাহ রেজিস্ট্রার রয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৭ জন কাজি জেলায় বিবাহ নিবন্ধন ও তালাকনামা করেছেন।
পাঁচবিবি উপজেলার বালিঘাটা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) শাহ্ আলম বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ নানা কারণে হচ্ছে। তবে গত বছর মুঠোফোনে পরকীয়ার কারণেই তালাক বেশি হয়েছে। উভয় পরিবারেরর সম্মতিতে বিয়ে হলেও কয়েক মাসের মধ্যে মেয়ে বা ছেলে অন্যত্র পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে আর তালাকের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যায় বেশি। আক্কেলপুর পৌরসভার কাজি মো. নূরুন নবী তালাকের এক উদাহরণ টেনে বলেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে চাকরি করেন। স্বামী তার চাকরিজীবী স্ত্রীকে যেভাবে চলতে বলেন স্ত্রী তার কথা শোনেন না। এ নিয়ে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়। দাম্পত্য জীবনে সন্দেহ তালাকের আরেকটি কারণ।
এখন বিবাহ আর তালাক প্রায় সমানের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। বছর পাঁচ-সাতেক আগে এমনটা হতো না। মেয়েরা বেশি তালাক দিচ্ছে। শতকরা ৭০ জন মেয়ে হলে ১০ জন ছেলে। আর বাকি তালাক আপসে হচ্ছে বলে মনে করেন জয়পুরহাট পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের কাজি সহিদুল ইসলাম। সদরের চকবরকত ইউনিয়নের কাজি রুহুল আমীন বলেন, গত বছরে এই ইউনিয়নে ৪৩টি তালাক হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি আপসে আর ২১টি মেয়ে কর্তৃক। স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হলেই তালাকের পথ বেছে নিচ্ছেন নারীরা। তালাকের পর তারা চলে যাচ্ছেন ঢাকায় গার্মেন্টস বা অন্যান্য সেক্টরে কাজের জন্য।
জয়পুরহাট জেলা রেজিস্ট্রার সহকারী আব্দুল খালেক বলেন, গত ২০২২ সালের ১২ মাসে বিবাহের তুলনায় ৭১ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। যা ২০১৯, ২০ বা ২১ সালেও এমন ছিল না। সে সময় ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশ তালাক হয়েছে। তাই গত এক বছরের বিবাহ বিচ্ছেদের হার এ জেলার জন্য উদ্বেগজনক। জয়পুরহাট জেলা রেজিস্ট্রার শরীফ তোরাফ হোসেন বলেন, বছরে যে পরিমাণ বিবাহ হচ্ছে তার চেয়ে তুলনামূলক তালাকই বেশি হচ্ছে। এ জেলায় যৌতুকের প্রথা বেশি। তাছাড়া মুঠোফোনে অন্যত্র কথা বলা, সন্দেহ, আর্থিক বিষয়সহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
যা বলছেন এনজিও কর্মী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা: ব্র্যাকের জয়পুরহাট সদর অফিসের অ্যাসোসিয়েট অফিসার সন্ধ্যা তপ্ন বলেন, আমরা কখনোই বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে নয়। যখন কোনো নবদম্পতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, আমরা গ্রুপের মাধ্যমে তাদের কাউন্সিলিং করি। যাতে তারা সংসার শুরু থেকে একে অপরের সঙ্গে কলহ না ঘটে। তাছাড়া নারীদের নির্যাতন করা হয়, তখন আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের জন্য চেষ্টা করে থাকি।
ক্ষেতলাল উপজেলার সরকারি ছাঈদ আলতাফুন্নেছা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তানজির আহমেদ সাকিব বলেন, বিভিন্ন কারণেই ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেখানে বিভিন্ন কারণে বিপন্ন হয়ে পড়লে সেই সম্পর্ক মনে হয়, জীবনে আর প্রয়োজন নেই। সেখানে সমাধান হিসেবে নেমে আসে বিবাহ বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের পরবর্তী পর্যায়ে, কেউ অশান্তির আগুন থেকে মুক্তির স্বাদ অনুভব করতে চান। আবার কেউ নিজের জীবনকে অর্থহীন ভাবেন। তবে সন্তান থাকলে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ওই সন্তানের ওপর নিশ্চিতভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক তাসলিমা খাতুন বলেন, নারীরা এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাধীন। বিয়ের পর তারা স্বামীর পরিবারের অনেক বিষয় মেনে নিতে পারে না। তাছাড়া এই ডিজিটাল যুগে খুব সহজে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায়। সেসময় নারী বা পুরুষ ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। টাইম পাস বা সাময়িক সুখ লাভের আশায় তারা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এটা তার পার্টনার (স্বামী বা স্ত্রী) মেনে নিতে পারে না। তখন তারা ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া সমাজে যৌতুক প্রথা কমে গেলেও সেটির সিস্টেম চালু আছে। যৌতুক না নিয়ে কিছু উপহার চেয়ে বসে। আর এটি ঘুরে ফিরে যৌতুক হয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে যখন বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে বিবাহের কিছু পরে স্বামী-স্ত্রী মধ্যে একটা কলহের সৃষ্টি হয়, আর তা থেকেই ডিভোর্স।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজের মানুষের চিন্তা ভাবনার এখনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকেই এখনো নারীকে বোঝা মনে করেন। তাই তারা বিবাহের পর নারীদের ওপর সংসারের সব চাপিয়ে দিতে চায়, আর এটা নারীরা মেনে নিতে পারে না। আমরা যখন এসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো, তখন এসবের সমাধান আসবে। এর জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার। দিন দিন সামাজিক প্রেক্ষাপট চেঞ্জ হচ্ছে। মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছে। অদৃশ্য শক্তির পেছনে দৌড়াচ্ছে। আগের দিনে মানুষ বিষণ্নতায় থাকতো। কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেটি করতে দেয় না। আর তখন অন্যত্র সম্পর্ক হয়ে থাকে। মানুষ চায় সারা দিন ব্যস্ত থাকতে, পরিবারকে সময় দিতে চায় না। আগের দিনে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা পরিবারকে জানাতে হতো, গ্রাম্য সালিস হতো। সেটি মীমাংসাও হতো। অনেক পরে ডিভোর্সের চিন্তা হতো। কিন্তু এখন কিছু হলেই তালাকের সিদ্ধান্ত। কারও প্রতি কারও দায়বদ্ধতা নেই। আর এসব নিয়েই ডিভোর্স বাড়ছে।