ভূমিকম্পে তুরস্ক-সিরিয়ার চেয়ে ঢাকা অতিবিপজ্জনক অবস্থায়
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:৩৬ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৪৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
‘চরিত্রগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় পলিমাটি দিয়ে গঠন, ব-দ্বীপ এবং তিনটি প্লেটের ওপরে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এই ঝুঁকির আরেকটি প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ বৃষ্টিবহুল এলাকায় অবস্থিত।’ তারা বলছিলেন, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব। তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এবং বাংলাদেশের ঝুঁকি ও প্রস্তুতি প্রসঙ্গ নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি মনে করেন, তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের চেয়েও রাজধানী ঢাকার অবস্থা অতিবিপজ্জনক। তিনটি কারণে এই বিপদের কথা বলছেন গবেষকরা।
প্রথমত, ঢাকার চারপাশ নদী আর খাল-বিলে ঘেরা। এখানকার গঠন পলিমাটির ওপর। এ কারণে ঢাকাকে ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি মাটির গঠন অনুসারেই বিপজ্জনক করবে। গোটা বাংলাদেশেই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ প্লেটের সঙ্গমস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আপনি চোখ বন্ধ করে যদি বোঝার চেষ্টা করেন, দেখবেন নিচ থেকে এসে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটকে পশ্চিম-উত্তর দিকে ধাক্কা মারলো। তখন নেপাল, হিমালয়, সিলেটের পুরো বেল্টটা সৃষ্টি হলো। আর দক্ষিণ-পূর্বদিকে বার্মিজ প্লেটে ধাক্কা দেয়ার পর তৈরি হলো আমাদের এবং মিয়ানমারের পার্বত্য অঞ্চল। অর্থাৎ তিনটি প্লেটের পারস্পরিক সংঘর্ষের কারণে তৈরি হওয়া এসব অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
চরিত্রগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, পলিমাটি দিয়ে গঠন, ব-দ্বীপ এবং তিনটি প্লেটের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এই ঝুঁকির আরেকটি প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ বৃষ্টিবহুল এলাকায় অবস্থিত। প্রাকৃতিক কারণ উল্লেখ করলেন। মনুষ্য সৃষ্ট কারণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের জন্য কী বলবেন?
বিশ্লেষণে বলেন, ‘আমাদের শহরগুলো অতিবিপজ্জনক হিসেবে গড়ে তুলেছি দুইভাবে। এখানকার শহরগুলো তুরস্ক, সিরিয়া বা ভারতের শহরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি জনঘনত্বের। সিরিয়া-তুরস্কের শহরগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার মানুষও বাস করে না। আমাদের শহরগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজার পর্যন্ত মানুষ বসবাস করছে। আর কোনো দেশে এমন দেখতে পাবেন না। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হবে ভূমিকম্প ঘটলে। পরিকল্পনা না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় কিছুই করা সম্ভব হয়নি। প্রকৌশলগত কাঠামো তৈরিতে আমাদের ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে।
বলা হচ্ছে, এখানে শতকরা ৯২ শতাংশ ভবনই অপ্রকৌশলগতভাবে তৈরি। অর্থাৎ কারিগরি দক্ষ লোক তৈরি করেনি।
তৃতীয়ত, এ ধরনের নগরায়নে মাঝে মধ্যেই আশ্রয়ের জন্য ফাঁকা জায়গা রাখতে হয়। এটি রাখা হয় যে কোনো বিপজ্জনক ঘটনার জন্য। কিন্তু আমরা বিপদের সময় দু দন্ড দাঁড়ানোর জন্য কোনো জায়গা রাখিনি। আমাদের সড়কগুলো ২০ ফুটও নিশ্চিত করতে পারিনি।’ ‘অর্থাৎ মনুষ্য সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে আমরা মুমূর্ষু শহর ঢাকা, চট্টগ্রামকে আরও বিপদগ্রস্ত করে তুলছি। কারণ আমরা খুব সস্তায় এই শহরগুলোতে গ্যাস পেয়ে গেছি। আমরা কোনো প্রকার বিবেচনা না করে গ্যাস সম্প্রসারণের লাইন তৈরি করেছি। এর জন্য আমরা কোনো রেকর্ডও রাখিনি। যখন দরকার পড়েছে তখনই আরেকটি লাইন করেছি। শহরজুড়েই মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিটার গভীরে অসংখ্য গ্যাসের লাইন রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে উচ্চচাপে গ্যাস প্রবাহিত হচ্ছে। যদি বড় ধরনের কোনো ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়, তাহলে এগুলো ফেটে যাবে এবং প্রচন্ড বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসবে। আপনি দেখবেন, যখন ভূমিকম্প হয় তখন বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্ফোরণ ঘটে। ভূমিকম্পের সময় বাতাস সম্প্রসারণ ও সংকোচন হয় বলে ওই অঞ্চল বোমার মতো হয়ে যায়। তুরস্ক-সিরিয়ায় আমরা এমন দেখতে পাইনি। কারণ তাদের শহরগুলো এমন অব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠেনি। এই সূচকগুলো বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকার বিপদ অনেক বেশি।’ যোগ করেন ইকবাল হাবিব। দুর্যোগের সময়কার যে প্রস্তুতি তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত কি না, এটিই এখন প্রধান প্রশ্ন। আপনার পাঠকের কাছে বুকে হাত রেখে জানতে চান, ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জানেন কি না? আমার ধারণা, ৯৫ শতাংশ পাঠক বলবেন, জানে না। ভূমিকম্পের সময় ভবনের বিম্ব-কলামের নিচে থাকতে হবে বা আলগা জিনিসপত্র থেকে দূরে থাকতে হবে সে বিষয়ে অবগত নয়। মাথা রক্ষার জন্য শক্ত কিছু একটা যে উপরে ধরতে হবে তাও জানে না। যেখানে আশ্রয় নেয়া যায়, সেখানে শুকনা খাবার, পানি, দিয়াশলাই রাখতে হয় তা অনেকে জানে না। এটি তো প্র্যাক্টিসের ব্যাপার। সচেতন না বলেই আমরা ব্যক্তি বা পারিবারিকভাবে এই চর্চাগুলো করি না। আবার আমাদের কমিউনিটিনির্ভর কাঠামোগুলোও ভেঙে গেল। কাউন্সিলর আছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও পরিচয় নেই। নিচতলার মানুষ ওপরতলার মানুষকে চিনি না। এতে সামাজিক বন্ধনটা আর নেই। কেউ কারও বিপদে এগিয়ে আসে না। ১৯৬৪ সালে আমার জন্ম। আশির দশক পর্যন্ত যে কাঠামো দেখেছি, সে কাঠামো আর নেই। পাশের বাসার কেউ মারা গেলে জানতেই পারি না বা জানার চেষ্টাও করি না। সব ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। রানাপ্লাজা ধসের পর সরকার ফায়ার ব্রিগেডের অধীনে মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তোলা, সচেতন করে তোলার কথা ছিল। সেটাও পারেনি। মহড়ার মাধ্যমে যে চর্চা রাখা, তা হয় না। এসব কারণে আমাদের জন্য হয়তো ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আল্লাহ ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো ভরসা নেই। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুক।’