পঙ্গু-শিশু-হৃদরোগ হাসপাতালের গণশৌচাগারে অস্বাস্থ্যকর-অনিরাপদ পরিবেশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:২৭ পিএম, ২৮ জানুয়ারী,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:৪৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
রাজধানীর অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগের টয়লেটগুলোর অস্বাস্থ্যকর। ভাঙা কমোড, নষ্ট পানির কল, দুর্গন্ধময় ও কাদাপানিতে মাখামাখি টয়লেটগুলো একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য বলে মনে করেন চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষ। সম্প্রতি রাজধানীর পঙ্গু, শিশু ও হৃদরোগ হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগ টয়লেটগুলো ঘুরে এসব দৃশ্য দেখা যায়।
মলমূত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পঙ্গু হাসপাতালের টয়লেটে : জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) নতুন বিল্ডিংয়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। হাসপাতালের দায়িত্বরত স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনে গড়ে ২ হাজার ৫০০ রোগী তাদের স্বজনকে নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় তলার বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। সেখানে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় তাদের। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর অনেকের প্রয়োজন হয় টয়লেটে যাওয়ার। কিন্তু যারা গিয়েছেন, তারা বের হচ্ছেন নাক চেপে। এসব দেখে অনেকের আর যেতে ইচ্ছে করে না, অনেকে গেলেও বমির উদ্রেক হয়। এক পর্যায়ে তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন অন্য কোনও টয়লেট। কারণ জানতে দ্বিতীয় তলার টয়লেটে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গন্ধময় টাইলস করা ফ্লোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মলমূত্র। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার তেমন কাউকে দেখা যায়নি। যে কেউ দৃশ্যটি দেখলেই অসুস্থ হয়ে যাবে বলে জানিয়ে আমজাদ নামের এক সেবাগ্রহীতা বলেন, ‘যেইখানে আমরা স্বাস্থ্যসেবা পাবার জন্য আসি আর সেখানকার টয়লেটই সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর। এখন বাজে দুপুর ১টা। এর মাঝে কেউ কি একবারও এইদিক আসেও নাই?’ এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চরম অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। শুধু দ্বিতীয় তলায় নয়, প্রথম তলার টয়লেটের পরিবেশও নোংরা। হাত ধোয়ার বেসিনের পাশেই রাখা হয়েছে টয়লেটের ফ্লোর পরিষ্কারের ঝাড়ু। নেই হাত ধোয়ার জন্য কোনও হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান। টয়লেটের ফ্লোরের যত্রতত্র পড়ে আছে ব্যবহৃত টিস্যু। পঙ্গু হাসপাতালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য রোগী তাদের অভিভাবক নিয়ে আসেন জানিয়ে পরিচালক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক গণি মোল্লা বলেন, টয়লেট অপরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আমাদের এখানে জটিল। একদিকে আগত জনসাধারণের অসচেতনতা, অন্যদিকে আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে আমরা জানিয়েছি। দেশের বর্তমান সংকটে সেখান থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়ানো হচ্ছে না। তবে খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।
শিশু হাসপাতালেও নারী-পুরুষের টয়লেট ভাঙা : শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য রয়েছে গণশৌচাগার। কিন্তু এর ভেতরের দৃশ্য দেখলে যে কারও দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত মনে হবে এগুলো। ভাঙাচোরা এসব টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে শিশু রোগীর সঙ্গে আসা নারী-পুরুষ উভয়কে। এ ছাড়া নারীদের জন্য নেই আলাদা কোনও টয়লেট। সরেজমিনে হাসপাতালটির সি-ব্লকের বহির্বিভাগের টয়লেটের প্রবেশমুখে গেলে মনে হবে রিসেপশনের পাশে কোনও এক ছোট স্টোররুম। দুই চেম্বারের এই টয়লেটের কমোডগুলো ছিল ভাঙা, কমোডের অধিকাংশজুড়ে নোংরা কালো দাগ। টয়লেটের প্রবেশপথ এতই ছোট যে একজন বের না হলে আরেকজনের ভেতরে ঢোকা কষ্টসাধ্য। বি-ব্লকের টয়লেট নামেমাত্র বানানো। লোহার দরজার নিচের অংশ ক্ষয় হয়ে তা এখন উন্মুক্ত। কাদাপানি পুরো টয়লেটে মাখামাখি করছে। স্যাঁতসেতে এই অবস্থার মধ্যে অনেকেই অস্বস্তিতে পড়েন। শিশু কন্যাকে নিয়ে চিকিৎক দেখাতে আসা অভিভাবক মিরাজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এগুলোরে কি কোনও টয়লেট বলে? হাসপাতালের গেটে অটোমেটিক দরজা লাগাইছে আর এর ভেতরের টয়লেটের অবস্থা দেখলে বিশ্বাসই হয় না এইটা একটা টয়লেট। বড়দের কথা বাদই দিলাম, আমার ছোট মেয়েটার জন্য একটু আগে ভালো একটা টয়লেটের জন্য এদিক-ওদিক ঘুরেছি। সবাই নিচের এই টয়লেট দেখায়া দেয়। একটা ভালো মানুষের পক্ষে এই টয়লেট ব্যবহার করা সম্ভব না। আবার নারী-পুরুষ-পোলাপাইন সবারই এই একটাই টয়লেট ব্যবহার করা লাগতাছে। শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গণশৌচাগারের বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি। শৌচাগারের অবস্থা এমন কিছু হয়ে থাকলে আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আপনাকে ধন্যবাদ বিষয়টি আমাকে অবগত করার জন্য।
তিনি আরও বলেন, নারী-পুরুষ একই টয়লেট ব্যবহার করবে, এইটা তো ঠিক না। এতে নারীরা বিব্রত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমি এর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগের টয়লেট নতুন কারও জন্য খুঁজে পাওয়া অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। হাসপাতালের কোনও স্টাফকে টয়লেট কোথায় জিজ্ঞেস করলে আঙুল উঁচিয়ে দক্ষিণ দিকে ইশারা করবেন। আর সেই ইশারা বরাবর শেষ সীমানায় গেলে মিলবে সাধারণের জন্য তৈরি করা টয়লেট। কিন্তু এই হাসপাতালে আসা নতুন যে কাউকেই তা খুঁজে বেগ পেতে হবে। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের একেবারে শেষ দেয়াল ঘেঁষে অন্ধকারে নির্জন স্থানে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য বরাদ্দ রয়েছে তিন চেম্বারের একটি টয়লেট, যা সেবা নিতে আসা নারীদের জন্য নিরাপদ নয় বলে মনে করেন খোদ হাসপাতালেরই কয়েকজন নারী স্টাফ। হৃদরোগ হাসপাতালের টয়লেট ঘুরে আরও দেখা যায়, পুরো টয়লেটে টুকরা টুকরা ব্যবহৃত টিস্যু পড়ে রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। টয়লেট দুটির ওপরের অংশ খোলা। দরজার ছিটকিনি নষ্ট। নেই হাত ধোয়ার জন্য কোনও বেসিন ও সাবান। খুব প্রয়োজন না হলে এই টয়লেটের দিকে কেউ আসেও না বলে জানান হাসপাতালে কর্মীরা। বরং টয়লেটের সামনে হাসপাতালের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস জড়ো করে স্টোর রুমের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক স্টাফ বলেন, এখানের বহির্বিভাগে আরও কিছু টয়লেট ছিল কিন্তু জায়গার সংকটে সেগুলো ভেঙে চিকিৎসকের চেম্বার করা হয়েছে। এখন এত বড় বহির্বিভাগে জন্য ওই একটাই টয়লেট। টয়লেটের এই বেহাল অবস্থার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টি জানার জন্য কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।