দীর্ঘ ১৯ বছর চাপা পড়ে আছে আরাফাত রহমান কোকো’র স্বপ্ন
কালাম আজাদ, দিনকাল
প্রকাশ: ১২:২১ পিএম, ২৬ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৩৭ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বগুড়া শহরের খান্দারে অবস্থিত শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের মূল গেইটে প্রবেশ করে ডান দিকে তাকালেই চোখের সামনে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নেমপ্লেট ভেসে আসে। শহীদ চাঁন্দু ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর এই ফলকটি ২০০৩ সালের ৩ জুন উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
বগুড়াকে ক্রীড়াঙ্গনের ‘সেকেন্ডহোম’ বানাতে চেয়েছিলেন বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সটি ছিল সেই স্বপ্ন পূরণের মূল সুঁতিকাগার। তৎকালীন সময়ে কিছু কিছু বাঁধা বিপত্তির কারনে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি কোকো। এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই যুগ। মার্বেল পাথরের সেই ফলক এখনো জ্বল জ্বল করলেও ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি।
বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বগুড়ার উন্নয়নে এগিয়ে আসেন দুই ভাই। বড়ভাই তারেক রহমান সামগ্রিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও ছোট ভাই কোকো’র স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। তিনি বগুড়াকে উত্তরাঞ্চলে ক্রীড়ার রাজধানী করতে চেয়েছিলেন। এখান থেকেই জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়াবিদ গড়ার স্বপ্ন ছিল তার। এলক্ষ্যে ২০০২ সালে শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন করা হয়। পরবর্তীতে আইসিসি এই স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদা দিলে ওয়ানডে এবং টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয়। ২০০৪ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় এই মাঠে। শুধু স্টেডিয়াম নয়, এই স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে আধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কোকো।
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারন সম্পাদক এম আর সিদ্দিক লেমন বলেন, “কোকো সাহেব বগুড়াকে ক্রীড়াঙ্গনের সেকেন্ডহোম বানাতে চেয়েছিলেন। শুধু ক্রিকেট নয়, সবধরনের খেলাধুলার আয়োজন একই জায়গায় করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর পরিকল্পনায় ছিল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে একটি আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়াম, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জিম, সর্বাধুনিক সুইমিংপুল, এ্যাথলেটিকস্ এর জন্য আলাদা মাঠ, ভলিবল মাঠ, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড এবং শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের ফাঁকা জায়গায় আবাসিক হোটেল। এই লক্ষ্যে স্টেডিয়ামের পাশের কৃষি খামারের কিছু অংশ নিয়ে সেখানে ফুটবল স্টেডিয়াম এবং এ্যাথলেটিক্স এর জন্য ট্র্যাক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন দায়িত্বশীল কিছু ব্যাক্তি সহযোগিতা না করায় সেটা সম্ভব হয়নি।”
এম লেমন আরও বলেন, “কোকো সাহেব বগুড়ায় আরেকটি বিকেএসপি গড়তে চেয়েছিলেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তিনি এসব স্বপ্নের কথা বলতেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেউ এগিয়ে আসেনি।”
শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়াম পূণ:নির্মাণকালীন সময়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাহবুবুর রহমান বকুল বলেন, “ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে বাস্কেটবল গ্র্উান্ড করা হয়। জাতীয় দল কিম্বা বিদেশী ক্রিকেটারদের অনুশীলনের কথা ভেবেই এটা করা হয়েছিল। কিন্তু যে কোন কারণে শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্স করা সম্ভব হয়নি।”
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শহীদ চাঁন্দু ক্রীড়া কমপ্লেক্স এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে বগুড়া উত্তরাঞ্চলের ক্রীড়া রাজধানী হয়ে উঠতো। বগুড়া থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় সরবরাহ করা যেত। বিশেষ করে ক্রিকেট এবং ফুটবলে উত্তরাঞ্চলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।’ একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি হলে এই অঞ্চলের ক্রীড়ার ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
আরাফাত রহমান কোকো’র ঘনিষ্টজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে গোটা ক্রীড়া জগতটাকে এক ছাতার নিচে আনতে চেয়েছিলেন। ওভার ব্রীজের মাধ্যমে এক স্টেডিয়াম থেকে আরেক স্টেডিয়ামে এবং সুইমিংপুলে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল খেলোয়াড়দের নিজস্ব আবাসিক হোটেলে রেখে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আধুনিক ক্রিকেট একাডেমিও করতে চেয়েছিলেন তিনি। বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরির জন্য শ্রীলংকান কিউরেটর নন্দসেনাকে দিয়ে স্টেডিয়ামে দুটি বাউন্সি উইকেট তৈরি করেছিলেন, যা দেশের অন্যকোন ভেন্যুতে ছিল না। সেই বাউন্সি উইকেটে অনুশীলন করেই বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এখনো সেই উইকেটগুলো দেশের সেরা বাউন্সি উইকেট হিসেবে বিবেচিত।
রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথেই বদলে গেছে বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা। অতীতের সব সাফল্য, অবদান ভুলে গেছেন কর্তারা। যেই নির্লোভ মানুষটি শহীদ চাঁন্দু স্টেডিয়ামকে সারা দুনিয়ায় পরিচিত করে তুললেন সেই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর দিনেও তাঁকে স্মরণ করেনা। শুধু তাই নয়; একসময় যারা শহীদ জিয়ার নামে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও কখনো এই দিনটি স্মরণ করেনা! রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন সেই সময়ের সুবিধাভোগী ক্রীড়া সংগঠকরাও। ফলে একজন কীর্তিমান ক্রমেই স্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছেন। মুছে ফেলা হচ্ছে তার পরিকল্পনা গুলোকেও। নতুন প্রজন্ম জানার সুযোগই পাচ্ছেনা মরহুম আরাফাত রহমান কোকো এবং তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বগুড়া তথা দেশের ক্রীড়ার উন্নয়নে কতটা অবদান রেখেছেন।
লেখক : কালাম আজাদ, সাংবাদিক।