নজরদারিতে থাকছে র্যাব
নির্বাচনে নিরপেক্ষ অবস্থানের বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৫৬ পিএম, ১৭ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৩২ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
প্রায় দেড় বছর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাহিনীর সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা পর থেকে এখন পর্যন্ত র্যাবের কর্মকান্ডে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দেশটি। আগামীতে র্যাবের মাধ্যমে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সেজন্য র্যাবকে নজরদারিতে রাখার বার্তা এসেছে দেশটির কাছ থেকে। পাশাপাশি সবার রাজনীতি করার অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনও দলকে সমর্থন না করে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার বার্তা দিয়েছে দেশটি। ঢাকা সফরে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক মার্কিন অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় এসব বার্তা দিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসব তথ্য নিন্ডিত করেছে।
র্যাব নিয়ে কী বার্তা দিল যুক্তরাষ্ট্র? লু’র ঢাকা সফর ঘিরে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বেশ আলোচনায় ছিল। প্রায় দেড় বছর আগে দেয়া নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে চেষ্টাও করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর মিলছে না। লু’র সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে আলোচনায় ছিল র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। ঢাকার পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, লু বলেছেন, যে কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলে যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানায়। আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, র্যাবের মধ্যে যারা ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
তারা বলেছে, নিষেধাজ্ঞার পর থেকে র্যাব অত্যন্ত ভালো কাজ করছে। র্যাবের অগ্রগতি নিয়ে খুশি তারা। তবে এটা নিয়ে খুব খুশি হওয়ার কারণ নেই বলেও জানিয়েছেন লু। তিনি বলেছেন, পরবর্তী সময়ে আবার যেন র্যাবের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কর্মকান্ড মনিটর (নজরদারি) করবে। মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, তার মানে এটা নয় যে, আরও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য তারা বসে আছে। বরং তারা অগ্রগতি দেখে খুশি। তবে এটাও ভাবা ঠিক হবে না আমরা ফ্রি।
সফরের দ্বিতীয় দিনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড লু র্যাব প্রসঙ্গে বলেন, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এ সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের দিকে তাকালে দেখবেন, র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে অগ্রগতি হয়েছে তা উঠে এসেছে, আমরাও সেটা দেখতে পেয়েছি। এটা প্রমাণ করে যে, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখেও র্যাব সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারে।
নির্বাচন প্রসঙ্গ : ডোনাল্ড লু’র সঙ্গে আলোচনায় সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা নিজেরাই বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলেছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের করার বিষয়ে লু’কে আশ্বস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে লু দেশের সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি তিনি নির্বাচনে এককভাবে কোনো দলকে সমর্থন না করে বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার বার্তা দিয়েছে।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের প্রসঙ্গটা আমাদের দিক থেকে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সরকার স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। তারা বলেছে, সবাইকে রাজনীতি করার অধিকার দিতে হবে। তবে কোনও দল যদি রাজনীতির নামে ভাঙচুর করে বা জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, সেটাকে সমর্থন করবে না যুক্তরাষ্ট্র।
মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে একভাবে কোনো দলকে সমর্থন দেবে না। তারা বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে।
প্রায় চার বছরের বেশি সময় ধরে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উদ্যোগ আইপিএসে যুক্ত হতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে আসছে দেশটি। লু’র সফরেও আইপিএসের বিষয়টি আলোচনায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে অস্ত্র-বিষয়ক গোপন তথ্য বিনিময় ও সুরক্ষার চুক্তি জিসোমিয়ার (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট) সইয়ের বিষয়টিও তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইপিএস নিয়ে আলোচনার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইপিএস নিয়ে তাদের ভাবনার কথা বলেছে লু।
তিনি বলেছেন, বাণিজ্যভিত্তিক বা সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার ও উন্নয়ন করে আমরা কাজ করতে পারি। তারা আমাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে, আমরা ব্যাখ্যা করেছি। বলেছি, আমরা সমুদ্রে কোনো দ্বন্দ্বে যেতে চাই না। মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা জানান, জিসোমিয়ার প্রসঙ্গও লু তুলেছেন।
তিনি বলেছেন, এমন নয় যে, আমাদের এখনই চুক্তি সই করতে হবে। আমাদের অস্ত্র কিনতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। আমরা বলেছি, তাদের যন্ত্রপাতি ব্যয়বহুল। আইপিএস নিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে লু বলেন, ভালো আলোচনা হয়েছে। এটা একটা কৌশল, ক্লাব না। বাংলাদেশ যুক্ত হলে অধিক রিসোর্সের সুবিধা পাবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সাল আরিফ। ফয়সালের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের দাবিতে বাংলাদেশে রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মার্কিন প্রশাসনের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। প্রশ্ন তোলেন দেশটি মানবাধিকার নিয়ে। ঢাকা সফরে ডোনাল্ড লু ফয়সালের নিহত হওয়ার ঘটনা নিজে থেকে তুলে ধরে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বোস্টনে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনাটি লু তুলেছেন। তিনি এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
লু বলেছেন, ওই ঘটনার ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে। এ বিষয়ে রিপোর্ট হওয়ার পর বিস্তারিত বলতে পারবেন তারা। ফয়সাল ন্যায়বিচার পাবেন বলে তিনি নিন্ডিত করেছেন।
আলোচনায় ছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘটনাও : সদ্য শেষ হওয়া বছরের শেষ দিকে রাজধানীর শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আলোচনা করেছেন বলে নিন্ডিত করেছেন কূটনৈতিক সূত্রগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পিটার হাসের বিষয়টাও আলোচনায় এসেছে। কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, একজন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের কর্তব্য। সে যে দেশেরই রাষ্ট্রদূত হোক।
তিনি বলেছেন, সব জায়গা এক রকম না। রাষ্ট্রদূত যে জায়গায় যাবেন সেটা যদি কোনো কারণে ঝামেলাপূর্ণ জায়গা হয়; সেটা আগে থেকে জানিয়ে রাখলে ভালো হয়। এসব ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানালে, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপত্তা দেবে। নিরাপত্তার কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। এছাড়া আলোচনায় ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টিও। এক্ষেত্রে এ আইনের সংশোধন নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার প্রশংসা করেছেন লু। শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন লু। সফরের শুরুতে ঢাকায় এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে তার ইস্কাটনের বাসায় নৈশভোজে অংশ নেয়ার পাশাপাশি বৈঠক করেন লু। সফরের দ্বিতীয় দিনে শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন লু। পরে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখান থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে লু পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এরপর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্রসচিবের দেয়া মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন লু। তিনি সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সফর শেষে ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা ছাড়েন ডোনাল্ড লু।