ধর্ষণ পরিসংখ্যানে তথ্যের ঘাটতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৪২ পিএম, ১ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৪৪ পিএম, ১০ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
প্রতি বছর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন কত নারী? দেশে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রকৃত সংখ্যা জানার উপায় কী? যে সব ঘটনায় মামলা হয় সেটাকেই কি সঠিক সংখ্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখনও অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলো মামলা পর্যন্ত গড়ায় না। গণমাধ্যমও সব ঘটনার খবর পায় না।
নারী অধিকার নেত্রীরা বলছেন, সামাজিক নানা রক্ষণশীলতা, লোকলজ্জা, ভীতি প্রদর্শন, অসচেতনতা ও থানা-পুলিশ নিয়ে শঙ্কার কারণে অনেক ঘটনাই জানাজানি হয় না। ফলে বাস্তবতা হলো, নির্যাতনের সব তথ্য নথিভুক্ত হয় না। বছর শেষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন দেয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে থাকে। এইসব প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ বলছে, তারা একটি ধারণা দিয়ে থাকেন, তবে সঠিক সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। এমনকি পত্রিকায় যখন অন্য কোনও ইস্যুকে গুরুত্ব দেয় তখন প্রতিনিধিরা ধর্ষণের খবর দেয়ার চেয়ে ওইসব সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগী থাকেন। ফলে কখনও সংখ্যা কমে, কখনও বাড়ে।
ইউনিয়ন থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ওইসব এলাকার বেশিরভাগ সংবাদই পত্রিকায় আসে না। আর অনেক ঘটনা থানা পর্যন্ত গিয়ে মীমাংসা করার ফলে সেসব তথ্য জানা যায় না। আবার এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য সংগ্রহের ধরনের কারণেও নির্যাতন-নিপীড়নের হিসাবে সংখ্যাগত পার্থক্য দেখা যায়। কোনও প্রতিষ্ঠান দিনে ১০টি পত্রিকার সংবাদ যাচাই বাছাই করে। কেউ কেউ আটটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ধরে তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। ফলে সংখ্যা এক হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে) সারাদেশে অন্তত এক হাজার ৩২১ জন নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০২১ সালে ১৩টি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা এক হাজার ২৩৫ জন বলে জানায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পত্রিকার ওপর ভিত্তি করে পকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে এক হাজার ৬২৭টি ধর্ষণ, ২০২১ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩২১ জন নারী। পাশাপাশি মহিলা পরিষদ ৯টি পত্রিকা দেখে করা প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে দেশে এক হাজার ৩৪৬ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আবার আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ধর্ষণের ঘটনা সর্বাধিক ৮৮টিই ঘটেছে ঢাকা জেলায়। এবারে ১০টি পত্রিকা থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। আবার জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সহিংসতার বিষয়ে আরেক ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে ধর্ষণের বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ না করে সূত্র জানায়, ২০২১ সালে সহিংসতার শিকার ১২ হাজার ১৬৯ জন নারীকে জরুরি সেবা দেয়া হয়েছে ৯৯৯-এ ফোন করার পর। আর চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে জরুরি সেবা দেয়া হয়েছে ২০ হাজার ১৩ জন ভুক্তভোগী নারীকে। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে নারী নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
‘উই ক্যান’ এর সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বলেন, ধর্ষণের পরিসংখ্যানগত তথ্যের ঘাটতি সাংঘাতিক। গণমাধ্যমে প্রায়োরিটির প্রশ্ন থাকে। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসে না। স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়রে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি, এই সাংবাদিকরা থানা থেকেও নিয়মিত তথ্য নেন না। আর নিলেও প্রকাশের জন্য পাঠানোর আগেই মীমাংসার ঘটনা ঘটে। বর্তমান সময়ে থানায় যাওয়া, মামলার পরিমাণ অনেক কমেছে। কারণ মানুষের মনে এক ধরনের পূর্বানুমান বাসা বেঁধেছে যে বিচারে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে যাওয়া-আসার চেষ্টা আগের তুলনায় কমেছে। কারণ এই হয়রানির জার্নির চেয়ে তারা যেকোনও ধরনের মীমাংসা করে নেয়ার জন্য ক্ষমতাবানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সংখ্যাগত তারতম্য বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, আমরা যে সংখ্যা প্রকাশ করছি তা পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে না। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সেল্ফ সেন্সরশিপ পেরিয়ে পত্রিকায় যেসব ঘটনা প্রকাশিত হয় আমরা সেই তথ্যটা এক জায়গায় করে প্রকাশ করি। সংস্থাগুলো কেউ পাঁচটা বা কেউ ২০টা পত্রিকা মনিটর করে। আবার কারও হয়তো তৃণমূল থেকে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ আছে, কারোর নেই। ফলে সংখ্যাগত পার্থক্য থাকে। মোদ্দা কথা হলো, সমাজে এ অপরাধ ঘটছে এবং রাষ্ট্র তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা দশটি পত্রিকা ও যে ভিকটিমরা সরাসরি আমাদের কাছে আসেন, তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি করি।