রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বেগ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:০০ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২২ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করলেও রিজার্ভ যথেষ্ট পরিমাণে আছে বলে দাবি করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেকেই নানা মনগড়া মন্তব্য করছেন। আমাদের বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।’
গত বছরের আগস্ট নাগাদ বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছালেও এখন সেটি ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মোট রিজার্ভের পরমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা এবং ঋণ হিসেবে দেয়া আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হয়।
সে হিসেবে বাংলাদেশে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর হিসাবটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘আমাদের থাম্বরুল আছে যে প্রতি মাসে গড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানির জন্য লাগে। সে হিসেবে সরকারের কাছে বড় জোর তিন মাসের কিছুটা বেশি রিজার্ভ আছে বলা যায়। পাঁচ মাসের নেই।’
তবে তিন মাসের এই রিজার্ভ থাকাকেও তিনি স্বস্তির বলে মনে করছেন না। কারণ এই রিজার্ভের পরিমাণ প্রতিনিয়ত ওঠানামা করছে। রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত অর্থ বেরিয়ে গেলেও সেই পরিমাণে যোগ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘তিন মাসের রিজার্ভ থাকাটাও নিরাপদ হতো, যদি সেটা স্থির থাকতো। কিন্তু বাংলাদেশে রিজার্ভে যে ক্ষয়টা হচ্ছে সেটা তো পূরণ করা যাচ্ছে না, কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। এ কারণে রফতানির চাইতে আমদানি ব্যয় বেশি থাকে। এজন্য রিজার্ভ কমছে আবার রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় নতুন করে সেভাবে যুক্ত হচ্ছে না।’
রিজার্ভের নিম্নমুখিতা বিপজ্জনক
একটি দেশের রিজার্ভ হলো সেই দেশটির রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, বিদেশী বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশে বা সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ।
সেই মজুদ থেকে আবার অনেক অর্থ খরচ হয়ে যায়। সাধারণত আমদানি, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশী কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি খাতে এই মুদ্রা খরচ হয়।
মোট মজুদ থেকে এই খরচ বাদ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যা সঞ্চিত থাকে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
করোনাভাইরাস ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্য পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায়, সেইসাথে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণে রিজার্ভের মজুদ কমে এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতিও ক্রমেই বাড়ছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব বলছে, অক্টোবরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। আয় হয়েছে ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১২.৮৭%।
চলতি অর্থবছরের জুন-জুলাই থেকে প্রবাসী আয় কমেছে রকেট গতিতে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। এক ধাক্কায় ৫০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন ১.৫২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় প্রায় ৭.৫৫% কম।
বৈদেশিক রিজার্ভকে একটি দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি ধরা হয়। কারণ বৈদেশিক লেনদেন হয় ডলারে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা মানে আমদানির সক্ষমতা থাকা।
বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় এখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ভারসাম্য থাকাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রার যথেষ্ট সঞ্চয় থাকলে বৈদেশিক ঋণ নেয়াও সহজ হয়।
ফলে রিজার্ভের অর্থ কমে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভের নিম্নমুখিতা দেখছি। কমছে আর কমছে। এমনটা চলতে থাকলে তো এটা তো চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমাদের আমদানি বন্ধ করারও উপায় নেই, আমাদের জ্বালানি তেল, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সব আমদানি করতে হবে।’
তবে রিজার্ভের অর্থ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের কল্যাণে এবং তাদের ভালোমন্দের জন্য রিজার্ভের টাকা খরচ হয়েছে।
তিনি জানান, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় সব ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশ ভ্রমণ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি অনেকটা বন্ধ ছিল। সে সময় রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অলস অবস্থায় না রেখে সেখান থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ দিয়ে একটা বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে
সেই তহবিলের অর্থ দিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, ‘সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ দেয়া হচ্ছে ২% হার সুদে। ঘরের টাকা সুদসহ ঘরেই ফেরত আসছে। এ অর্থ যদি বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হতো তাহলে ৪/৫ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হতো। আর তা পরিশোধ করতে হতো রিজার্ভ থেকেই।’
এদিকে রিজার্ভ কমার কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, গম, ভাল, ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য কিনে দেশের বাজারে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করার কারণে তার একটি প্রভাব গিয়ে পড়েছে রিজার্ভে।
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অযথা গুজবে কান দিবেন না। ব্যাংকে টাকার কোনো ঘাটতি নেই। উপার্জিত টাকা ঘরে রেখে বিপদ ডেকে আনবেন না।’
করণীয় কী
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, একটি দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে রিজার্ভ থাকলে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার পরিবর্তে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করা যায়।
‘এক্ষেত্রে হঠাৎ কোনো সংকট হলে রিজার্ভে সেই অর্থ ফেরানো সম্ভব হবে কি না সেটা নিরূপণ করা জরুরি,’ বলেন তিনি।
তার মতে, সরকার রিজার্ভের টাকায় যে তহবিল করেছে সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যই ব্যবহার হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, দেশীয় বিনিয়োগ থেকে যে আয় হচ্ছে সেটি টাকায় হয়, ডলারে নয়।
বিনিয়োগের টাকাটা একবারে বেরিয়ে গেলেও সেখান থেকে আয় আসে ধীরে ধীরে। যার কারণে হঠাৎ রিজার্ভের দরকার পড়লে সেটা তৎক্ষণাৎ পাওয়ার উপায় থাকে না।
রফতানিমুখী বিনিয়োগ হলে হয়তো সেটা বৈদেশিক মুদ্রা আনতে কাজে লাগে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু রফতানিমুখী নয় সে কারণে ঝুঁকি থেকেই যায় বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে সরকারকে চার ধাপে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ফাহমিদা খাতুন।
প্রথমত, তিনি অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানী নিয়ন্ত্রণ করার ওপর জোর দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স যেন ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন।
তৃতীয়ত, ডলার ও টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। যেন সব জায়গায় দাম সমান বা কাছাকাছি থাকে।
সবশেষে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অনেক ডলার বিদেশে রয়ে যাচ্ছে, সেগুলো দেশের অর্থনীতিতে যোগ করার ব্যবস্থা করতেও বলেছেন তিনি।
আমদানিকারক ১০০ ডলারের এলসি খুললেন এবং ব্যাংক থেকে সেই টাকা বিদেশে চলে গেল। কিন্তু তিনি কিনলেন ৩০ ডলারের পণ্য। বাকি ৭০ ডলার তিনি বিদেশের অ্যাকাউন্টে রেখে দিলেন। এটি ওভার ইনভয়েসিং।
অন্যদিকে আন্ডার ইনভয়েসিং হলো রফতানিকারক বিদেশে ১০০ টাকার পণ্য বিক্রি করলেন কিন্তু দেশে আনলেন ৩০ ডলার। বাকিটা বিদেশের অ্যাকাউন্টে রেখে দিলেন।
সূত্র : বিবিসি