সর্বোচ্চ সুদেও ব্যাংকে টাকা রাখছেন না গ্রাহক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০২ পিএম, ১৫ জুলাই,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:৫৭ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমানতের সুদহার বাড়তে বাড়তে এখন ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সুদহার গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এমন আকর্ষণীয় সুদেও ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন দেশের মানুষ। নগদ টাকা ব্যাংকে না রেখে হাতেই রাখছেন বেশি। এতে করে ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার পরিমাণ ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি বেড়েছে।
দেশে ছাপানো টাকার পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাস শেষে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা আগের মাস এপ্রিলে ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। গত মে শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে মাত্র ২০ হাজার ১৫১ কোটি টাকা, যা গত ২৩ মাসে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল ১৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকে নগদ টাকা রাখার পরিমাণ বেড়ে গত মার্চে সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। তবে এপ্রিল থেকে আবারও ব্যাংকে নগদ টাকা কমতে দেখা গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্মার্ট সুদহার ব্যবস্থা বাতিল করে চলতি বছরের মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক সুদহারের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকে আমানতের সুদহার আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশের ওপরে। কিন্তু সুদহার বাড়লেও ব্যাংকে নগদ টাকা জমার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনা। উল্টো মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও কমছে না। সর্বশেষ গত জুনে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও তা এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরই রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা সবচেয়ে কম ছিল গত অক্টোবরে, ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এরপর থেকে টানা আট মাস ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে। গত নভেম্বরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গিয়ে গত মে মাসে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালের মে মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির একটা প্রভাব রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের একই জিনিসের জন্য বেশি টাকা দরকার হচ্ছে। এর ফলে নগদ টাকা হাতে রেখে মানুষ সাংসারিক ব্যয় মেটাচ্ছে, এটা একটা বাস্তবতা। মূল্যস্ফীতি যদি কিছুটা কমে আসে তখন মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতাও ফিরে আসবে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, কিছু কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাও কমে যাচ্ছে। সেটার ফলেও মানুষ ওইসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছে।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে ফেরত আসে না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ হয় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে, নয়তো বেশি লাভের আশায় ব্যাংকের বাইরে বিভিন্ন সমিতি, জমি, ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে ঘরেও রেখে দেন।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে মে মাসে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে পরের মাসে ছিল কোরবানির ঈদ। যার কারণে অনেক মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখে খরচ করার জন্য। ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ। মার্চে বেশ কিছু ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্তের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেন আমানতকারীরা। অবশ্য উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি ইতিবাচক থাকলেও পরবর্তী আট মাসে তা ঋণাত্মক হয়েছে।