রাজধানীতে জনসভার স্থানগুলো একে একে বিলুপ্ত হলো কেন
আলী মামুদ, দিনকাল
প্রকাশ: ০৫:১৫ পিএম, ১১ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৪২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ করার অধিকার সুনিশ্চিত করা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯টি বিভাগীয় সম্মেলন শেষে ঢাকায় ১০ম বিভাগীয় সম্মেলন করতে গিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাবেশের স্থান নিয়ে বাধা দেয়া হয়েছে। আগে এ ধরনের সমাবেশ দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অনুমতি নিয়ে হলেও এবার তা শেষ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এই সমাবেশস্থল নির্ধারণে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পুলিশের আলোচনার পর আলোচনা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস শেষ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
গত ৮ ডিসেম্বর রাত ৩টায় এসব নিয়েই আলোচনার কথা বলে তাদেরকে বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি অফিসে। জনসভার স্থান নিয়েও সেখানে আলোচনা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোর্টে পাঠানো হয়, সেখানে জামিনও মেলেনি। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সারাবিশ্ব বিবেক বিস্ময় প্রকাশ করেছে জনসভার স্থান নিয়ে শেষ পর্যন্ত শীর্ষ নেতাদের জেলে পাঠানোর ঘটনা দেখে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্ত্রী বেগম রাহাত আরা ও মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। গভীর রাতে এভাবে মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া চরম অমানবিক। অনেকটা পাকিস্তানি স্টাইলের মতো।
উল্লেখ্য, গত বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন। এতে মার্কিন মুখপাত্র বলেন, আমরা পুলিশের হয়রানি নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা যেভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নেড প্রাইস বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারকে মুক্ত মত, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা এবং সম্মান জানানোর আহবান জানাই। আমরা পুলিশের হয়রানি, বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেফতার এবং তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি রিপোর্টগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন। একইভাবে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে এবারের মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের দূতের দেয়া এক বিবৃতিতে এই সতর্কতা জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে জাতিসংঘ বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বটে।
জনসমাবেশের গুরুত্ব: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সভা-সমাবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তৎকালীন রেসকোর্স ও পল্টন ময়দানে বড় বড় জনসভা হতো। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এসব জনসভায় ভাষণ দিতেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও জনসভার প্রচলন দেখা যায়। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বড় বড় জনসভা করতো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জেএসডি। এতে আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখতেন আ স ম আব্দুর রব। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বড় বড় জনসভা হতো। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এসব জনসভায় বক্তব্য রাখতেন। উল্লেখ্য, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে এখন বড় বড় জনসভার স্থান রয়েছে, অথচ ঢাকায় নেই। বিস্ময়কর।
১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের সময় বড় বড় জনসভা হয়েছে। সে সময় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়োজিত এক বিরাট-বিশাল জনসমাদৃত ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যখন এই সমাবেশে উত্তাল জনতার উদ্দেশে বলেন, ওদের হাতে পরাধীনতার শৃঙ্খল, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা...। তখন বিশাল জনতার উদ্বেলিত-উত্তোলিত দুই হাতের সমাহারের সমর্থন রচনায় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সম্ভবত এই জনসভার প্রভাবেই ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বলা হয়ে থাকে।
জনসভার স্থান নিয়ে: ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সবার আগে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সুপরিসর সড়ক পথের মাঝ বরাবর ট্রাফিক আইল্যান্ড হিসেবে খেজুর গাছের সারি সৃষ্টি করে। রেসকোর্স ময়দানকে বৃক্ষ পার্কও সেই ধারায় ‘উন্নয়ন’ করা হয়েছে। সেই রেসকোর্স বা সোহরাওয়ার্দী পার্কে এখন কোটি কোটি টাকার স্থাপনা। এমনকি পুরানা পল্টন-তোপখানা রোডের চৌহদ্দিতে মুক্তাঙ্গনে এখন গার্ভেজ-কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি উদ্বোধন করেছেন বর্তমান মেয়র শেখ তাপস, তার পাশে ছিলেন রাশেদ খান এমপি। অথচ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় ১৯৭৭ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত জনসভার জন্য ‘মুক্তাঙ্গন’ সৃষ্টি করেছিলেন।
বিষয়টি এই দাঁড়ালো যে, জনসভার জন্য এখন স্থানও নেই সুযোগও কমে যাচ্ছে। যানবাহন চলাচলের অসুবিধার কথা বলে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটলো। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস (ঢাকার সাবেক মেয়র) গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতার হয়েছেন সাবেক এমপি খায়রুল কবির খোকন যিনি একজন ডায়াবেটিস রোগী। তাকে ডিভিশনও দেয়া হয়নি। যা মর্মান্তিক!