শ্রম আদালতের মামলায় বাড়ছে দীর্ঘসূত্রতা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৫২ পিএম, ২৭ নভেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
শ্রম নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশে একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ও ১০টি শ্রম আদালত রয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে আরও তিনটি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠার। এরপরও বেশকিছু জটিলতায় এসব আদালতে মামলার জট বাঁধতে শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশের একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের হয়েছে ২১৪টি। এই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১২টি মামলা। আরও আগে দায়ের হওয়া সব মামলা মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালে অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে এক হাজার ৩৯৮টি। একই সময়ে (২০২১-২২ অর্থ বছরে) শ্রম আদালতগুলোতে দায়ের হয়েছে ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা। এই এক বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ছয় হাজার ৮৫৯টি মামলা। এখনও অনিষ্পন্ন রয়েছে ২৩ হাজার ৫১১টি মামলা।
মামলার জট বাড়ছে যেসব কারণে : শ্রম আদালতের মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে মতামত দিয়েছেন কয়েকজন আইনজীবী। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে এসব আদালতে মামলাজট ও দূর্ঘসূত্রতার বিভিন্ন বিষয়। আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন, অ্যাডভোকেট মামুন ভূঁইয়া এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন আইনজীবী কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন।
বিচারক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা : প্রায় সময়েই নিয়োগ, বদলি অথবা অবসরজনিত কারণে শ্রম আদালতের বিচারকের পদ শূন্য হয়। এদিকে দেশের একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদটিতে এক বছর বা দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু পদ শূন্য হওয়ার পর চার থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লাগে শূন্য পদে বিচারক নিয়োগে। ফলে এই সময়ে জমে থাকা মামলার জট নিরসন করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রম আদালতের বিচারকদের বদলি : আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতের বিচারকরা প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। আর স্বাভাবিক ভাবেই শ্রম আদালতের বিচারকার্য সম্পর্কে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লেগে যায় তাদের। যখনই একজন বিচারক শ্রম আদালত পরিচালনায় দক্ষতা প্রদর্শন শুরু করেন, ঠিক তখনি স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ফলে শ্রম আদালত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়।
শ্রম আদালতের সদস্য উপস্থিতি সংক্রান্ত জটিলতা : শ্রম আইনের বেশ কিছু ধারার মামলা নিস্পত্তির ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি সমন্বয়ে আদালত গঠন করতে হয়। ফলে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় ধার্য তারিখে নির্দিষ্ট প্রতিনিধির অনুপস্থিতির কারণে মামলা নিষ্পত্তি করা যায় না।
অধিক্ষেত্রজনিত জটিলতা : অধিক্ষেত্রজনিত কারণে বেশিরভাগ মামলাই দায়ের হয় ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রম আদালতে। ফলে একজন বিচারকের পক্ষে এতো বিপুল পরিমাণ মামলার চাপ সামলানো কষ্টকর হয়। এতে করে বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। সহায়ক কর্মচারীদের অদক্ষতা : আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং বিদ্যমান শ্রম আদালতের কর্মচারীদের কোনোরকম পদোন্নতি ও বদলির সুযোগ নেই। ফলে যোগ্য ও দক্ষ কর্মচারীরাও ধীরে ধীরে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। এটাও মামলার জট তৈরির পেছনে একটা কারণ হিসেবে কাজ করে।
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাব : শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। শ্রম আইন-২০০৬ এর ২১৮ ধারা অনুযায়ী শ্রম আদালতসমূহের তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের। অথচ মন্ত্রণালয় বার বার বার্তা দিচ্ছে যে, শ্রম আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রমের ক্ষমতা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। ফলে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেও মামলাজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের স্থান সংকট : দেশের শ্রম আদালতসমূহ এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত ভবনে অবস্থিত। ফলে সহায়ক কর্মচারী, সুপরিসর এজলাস, আইনজীবী এবং পক্ষদ্বয়ের পর্যাপ্ত বসার স্থান এবং উপযুক্ত পরিবেশ নেই। যা বিচারকার্য দীর্ঘায়িত করতে সহায়ক। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য অধিদফতরের জন্য নবনির্মিত সুপরিসর কার্যালয় রয়েছে।
উত্তেরণের পথ : আইনজীবীরা বলছেন, শ্রম আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও জট সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে দ্রুততার সঙ্গে শ্রম আইনে কার্যকর সংশোধন আনতে হবে। শ্রম আইনে আদেশের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে শ্রম আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়েরের পরিবর্তে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের মতো সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার বিধান প্রণয়ন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে করে ট্রাইব্যুনালে আপিলের সংখ্যা বাড়লেও মামলাজট কমবে। কেননা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে থাকে। একইসঙ্গে শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারকের পদ শূন্য হওয়ার পর দ্রুত শূন্যপদে বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন আইনজীবীরা। শ্রম আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে শ্রম আদালতে নিয়োজিত ছিলেন এমন বিচারকদেরকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন বলে তারা জানান। শ্রম আদালতগুলোর জন্য উপযুক্ত বিচারিক পরিবেশের স্বার্থে মানসম্মত ভবনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
যা বলছেন আইনমন্ত্রী : এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দেশের মামলা জটের বিষয়টি শ্রম আদালতেও চলে এসেছে। মূলত দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই শ্রমিকেরা মামলা করতে আসেন। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হলে মালিকপক্ষের সুবিধা হয়। শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই এসব আদালতের মামলা নিষ্পত্তি দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য আমরা অবশ্যই আলোচনাসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।