প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ
ওসির সঙ্গে বাদানুবাদ দেখে কনস্টেবল গুলি চালান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৫৭ পিএম, ২০ নভেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:০৮ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
কুমিল্লা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে প্রচারপত্র বিতরণ শেষে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই মিছিল থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। তাদের প্রচারপত্র ছাড়ানো নিয়ে ওসির সঙ্গে নেতাকর্মীদের তর্কবিতর্ক হয়। তা দেখে এগিয়ে গিয়ে এক কনস্টেবল গুলি চালান। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রদল নেতা নয়ন মিয়া (২৬) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আজ রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে থাকা একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘটনার এমন বর্ণনা দেন। গুলিবিদ্ধ নয়নকে উদ্ধার করে প্রথমে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ঢাকায় নেয়ার পথে মৃত্যু হয়। নয়ন উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ও চরশিবপুর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি চরশিবপুর গ্রামের রহমত উল্লাহর ছেলে। আলিফ মিয়া নামে তার দুই বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে গতকাল বিকেলে পুলিশ আহতের ঘটনায় এসআই আফজাল হোসেন বাদী হয়ে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০০ থেকে ১২০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। গতকাল রাত থেকে বাঞ্ছারামপুরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গত শনিবারের কর্মসূচিতে থাকা উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন, সদস্যসচিব লিটন সরকার, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক ইমান বলেন, তারা গতকাল উপজেলা সদরের মোল্লাবাড়ির সামনে থেকে প্রচারপত্র বিলি শুরু করেন। প্রচারপত্র বিতরণ শেষে একটি মিছিল নিয়ে বাজার, উপজেলা পরিষদ, থানা এলাকা প্রদক্ষিণ করে পুনরায় মোল্লাবাড়ি সেতুর দিকে আসেন। তখন পুলিশ তাদের কয়েকজন কর্মীকে আটক করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি সাইদুজ্জামান কামাল তাদের ছাড়িয়ে আনতে যান। তিনি দুজনকে ছাড়িয়ে আনলেও পুলিশ দুজনকে ধরে নিয়ে যায়। ছাত্রদল ও যুবদলের নেতারা আরও বলেন, একপর্যায়ে বাঞ্ছারামপুর থানার ওসি সাইদুজ্জামানের কাছে প্রচারপত্র বিতরণের অনুমতি কে দিয়েছে, তা জানতে চান। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে অনুমতি নিয়ে ওসির সঙ্গে তাদের বাদানুবাদ হয়। একপর্যায়ে ওসি সাইদুজ্জামানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে চান। তখন দূর থেকে একজন কনস্টেবল এসে গুলি চালান। এতে নয়ন গুলিবিদ্ধ হন। নেতাকর্মীদের দাবি, গুলি করার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তারপরও পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ঘটনাস্থল মোল্লাবাড়ি সেতু ও মসজিদ এলাকার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা মিছিল করছিলেন। পুলিশ তাদের পেছনে পেছনে আসে। মিছিল শেষ অবস্থায় ছিল। তখনো কোনো ধরনের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ বা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ এক কনস্টেবল দূর থেকে ওসির সঙ্গে বাদানুবাদ দেখে অতিউৎসাহী হয়ে গুলি করে বসেন। এতে ওই ছাত্রদল নেতা গুলিবিদ্ধ হন। পরে নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। বাঞ্ছারামপুর থানার ওসি নূরে আলম বলেন, ‘মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় থানার মোড়ে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন।’ ভিডিও ফুটেজে আপনাকে সেতুর ওপর দেখা গেছে জানালে তিনি বলেন, ‘ওই সেতুকে মোল্লাবাড়ি সেতু) থানা সেতু বলে। তারা সেখান থেকে থানার দিকে ফিরে আসেন। পরে পুলিশ দুটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে।’
একটি গুলি ছোড়ার কথা বলেছিলেন উল্লেখ করলে ওসি বলেন, ‘দুই রাউন্ডই বলেছি। আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন।’ এদিকে সরেজমিনে চরশিবপুর গ্রামে দেখা গেছে, সন্তান হারিয়ে নয়নের মা তাসলিমা বেগম, বাবা রহমত উল্লাহ, স্ত্রী সাজিদা আক্তার আহাজারি করছেন। সাজিদার কোলে তার দুই বছর বয়সী সন্তান আলিফ। কিছু বুঝতে না পারলেও মায়ের কান্না দেখে সে-ও কাঁদছিল। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানসহ অন্য নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে নয়নের বাবাসহ পরিবারকে সান্ত¡না দিতে দেখা গেছে। নয়নের স্বজনরা জানান, এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ভাইদের মধ্যে বড়। তিনি গাজীপুরের কালীগঞ্জে একটি কারখানায় কাজ করতেন। বড় বোন সুমি শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। বড় বোনের একটি ছেলে আছে। বাবা রহমত উল্লাহর বাজারে একটি টংদোকান আছে। স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবাসহ সবার ভরণপোষণ নয়নই চালাতেন। নয়নের মা তাসলিমা বেগম বলেন, ‘পুলিশ নয়নকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা এখন কূলহারা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। কেন আমার ছেলেকে পুলিশ গুলি করল?’ বিএনপির নেতা আবদুল মান্নান বলেন, নয়নের লাশ সন্ধ্যায় বা রাতে বাড়িতে আসবে। লাশ আসার পর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ ঘটনায় পুলিশকে আসামি করে মামলা করা হবে। এদিকে ছাত্রদল নেতা নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় শনিবার রাতেই শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেন জেলা ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীরা। গতকাল বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরের শিমরাইলকান্দি রেলগেট থেকে পাওয়ার হাউস রোড পর্যন্ত জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। জেলা ছাত্রদলের সভাপতি রুবেল চৌধুরী বলেন, ফুটেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে পুলিশের কোন সদস্য নয়নকে গুলি করেছে, তা শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।