সংকটেও মার্কিন লবিস্টের পেছনে সরকারের ডলার খরচ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:২৫ পিএম, ১৩ নভেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:২২ এএম, ৪ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ডলার সাশ্রয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ কারণে জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে হিমশিম অবস্থা। ডলার মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পণ্যের কাঁচামাল, ভারী যন্ত্রাংশ আমদানিতেও অনেক ব্যাংক ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে না। কোনো কোনো ব্যাংক এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। ডলার বাঁচাতে সরকারি খরচে কর্মকর্তাদের সব রকম বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এত কিছুর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে পিআর ও লবিস্টে ডলার খরচে রাশ টানতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মার্কিন আইন দপ্তরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরে বাংলাদেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টের কাজ করছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে নেলসন মুলিনস রিলে অ্যান্ড স্কারবোরো এলএলপিকে নিয়োগ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিতে সই করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশকে সেবা দেবে নেলসন মুলিনস। এ জন্য মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। এর বাইরে যদি বাংলাদেশের স্বার্থে নেলসন মুলিনসের কোথাও যেতে হয়, সেই খরচও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহন করবে। চলতি বছরের মাঝামাঝি মার্কিন কংগ্রেসের যে কর্মকর্তারা রয়েছেন, এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করিয়ে দেয় নেলসন মুলিনস। বর্তমান ও সাবেক একাধিক কূটনীতিক এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কূটনীতিক বলেন, কংগ্রেস সদস্য হলেও একটি কথা ছিল। কংগ্রেসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য যদি লবিস্ট ধরতে হয়, তাহলে এত ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাস রেখে লাভ কি? তাদের সক্ষমতা কী? র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশের পর চলতি বছরের ১ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও হতাশা প্রকাশ করা হয়।
লবিং কার্যক্রম নিয়ে কথা হলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, এ কার্যক্রমের সুবিধাও রয়েছে, সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় সাফল্য পেতে গেলে যে বিষয়ে লবিং পরিচালনা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আগেই লক্ষ্য ঠিক করে পদক্ষেপ নিলে লবিং কার্যকর হবে।
এদিকে, নেলসন মুলিনস থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের মার্চে মার্কিন আরেক পিআর ও লবি প্রতিষ্ঠান বিজিআর পাবলিক রিলেশনকে নিয়োগ করে বাংলাদেশ। বিজিআরকে নিয়োগ দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে। বিজিআরের সঙ্গে চুক্তিতে সরকারের পক্ষে সই করেন রাষ্ট্রদূত। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এক বছর বাংলাদেশকে নানা বিষয়ে সহায়তা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য মাসে ২৫ হাজার ডলার করে গুনতে হবে বাংলাদেশকে। এর সঙ্গে ফটোকপিসহ অন্যান্য খরচের জন্য মাসে ২০০ ডলার ছাড়াও বিজিআর যদি বাংলাদেশের কাজে কোথাও বিদেশ ভ্রমণ করে, সেই খরচও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। বর্তমানে মার্কিন লবিস্ট বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
ডলার সংকট ও সাশ্রয়ের বিষয়ে সমকালকে তিনি বলেন, 'আমাদের ডলার সংকট তো নাই। কে বলেছে ডলার সংকট? ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ডলারের রিজার্ভ ছিল তিন বিলিয়নের মতো। এখন ডলারের রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন।' ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এগুলো খামাখা কথা যে ডলার সংকট। আমার কোনো (ডলার) সংকট নাই। আমার (বাংলাদেশের) যে ডলার খরচ হয়, সেটি আয়ও হয়। আমার ৬০ মাস বা পাঁচ বছরের রিজার্ভ আছে। সেই সঙ্গে আমার ক্রমাগত আয় হচ্ছে। এগুলো খামাখা আপনারা বলে বেড়ান।'
লবিস্টে ডলার খরচের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, 'এগুলো খুবই অল্প টাকা। দুই হাজার ডলারের মতো খরচ হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস রয়েছে, যারা দেশটিতে বাংলাদেশের বড় লবিস্ট। বাংলাদেশ কাজের ভিত্তিতে লবিস্ট নিয়োগ করে। কোনো কাজ এলে সেই কাজের ভিত্তিতে ৫ হাজার বা ১০ হাজার ডলার খরচ করে। যে মাসে কাজ করা হয়, সেই মাসে এ অর্থ খরচ হয়। সারাবছরের জন্য বাংলাদেশ লবিস্টে অর্থ খরচ করে না। আর করলেও খুবই সামান্য অর্থ খরচ হয়। অনেক সময়ে বেসরকারি মানুষরা এ অর্থ দিয়ে দেয়, বাংলাদেশের করদাতাদের অর্থ খরচ হয় না।' চলতি বছরের মার্চে মার্কিন আরও তিনটি লবি প্রতিষ্ঠান সরকারের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি নুরনবার্গার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। তবে এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার সরাসরি নিয়োগ করেনি। সরকারের হয়ে এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ করেছে নেলসন মুলিনস। যে প্রতিষ্ঠানকে মাসে কমপক্ষে ৫ হাজার ডলার করে দিতে হচ্ছে। একইভাবে পোটোম্যাক স্কয়ার গ্রুপকেও নেলসন মুলিনস বাংলাদেশ সরকারের জন্য নিয়োগ করেছে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ করার জন্য কমপক্ষে ২০ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছে। আর আইস মিলার এলএলপি নামে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৬ মাস বা তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগকর্তা হলেন সরকারদলীয় ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। চুক্তি অনুযায়ী বছরে ১ লাখ ৬২ হাজার ডলার পরিশোধ করা হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে করা চুক্তি অনুযায়ী ১ মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠানটি সেবা দেওয়া শুরু করেছে। তাহজীব আলম সিদ্দিকীকে আইস মিলার বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বাড়াতে কৌশল তৈরি দেবে। বিশেষ করে মানবাধিকার ও জঙ্গিবাদ দমন নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকসহ বাইডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে টেলিফোন ও মেসেজে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দর বাড়ার প্রভাবে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে। সে তুলনায় বাংলাদশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়েনি। এতে ডলারের বিপরীতে টাকা অনেক দুর্বল হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতেও আমদানির জন্য প্রতি ডলার খরচ হতো ৮৬ টাকা। এখন গড়ে ১০৬ টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। এ রকম দর দিয়েও ডলার পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। অনেক ব্যাংকের কাছে এলসি খোলার মতো ডলার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করেও বাজারে স্বাভাবিকতা ফেরাতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫২০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। গত অর্থবছর বিক্রি করেছিল ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির ফলে এরই মধ্যে রিজার্ভ কমে এখন ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের আগস্টে যেখানে রিজার্ভ উঠেছিল সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে হিসাব করলে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এ পরিমাণ রিজার্ভ চার মাসের কম আমদানি দায় মেটানোর সমান। এ অবস্থায় কিছু শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে আইএমএফ। দেশের স্বার্থেই লবিস্ট রাখা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে সরকার লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে হয়তো এ লবিস্ট খরচে সরকারের আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।