সীমাহীন লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগে দেশবাসী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২৩ এএম, ২৪ অক্টোবর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৪২ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
দেশে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং শুরু হয়েছে। খোদ রাজধানীতে এলাকাভেদে দিনে রাতে সাত থেকে আটবার বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। সকাল থেকে গভীর রাত এমনকি শেষ রাতেও বাদ যাচ্ছে না এ লোডশেডিং।
এতে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে মানুষ। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভুল নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে। দায়মুক্তি আইন করে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে; কিন্তু এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস বা কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি প্রায় এক দশক আগে পাশের দেশের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করা হলেও গ্যাস উত্তোলনের কোনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার গত চার বছর যাবৎ পাশের ব্লক থেকে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলন করে চীন ও ভারতের কাছে বিক্রি করছে। প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে না পারায় এখন জ্বালানি সঙ্কটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে, যার প্রভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সঙ্কটে বন্ধ হওয়ার পথে অনেক শিল্পকারখানা।
এ দিকে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কী হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। ২৫ ডলার দাম ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলায় সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।
গতকাল রোববার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পে জ্বালানি সঙ্কটের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, রাজধানীর বনানীতেই গতকাল চারবার বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। গভীর রাতেও অর্থাৎ রাত ১২টার সময়ও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সীমাহীন অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীন প্রকল্প বাস্তবায়নকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, আজ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ডলারের সঙ্কটের কারণে জ্বালানি কেনা যাচ্ছে না। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে সব সময়ই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে কমে। বাড়ে কমে ডলারের দামও। চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কট এসব কারণে যতটুকু না হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি এর কারণ হলো সরকারের ভুলনীতি।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে দায়মুক্তির কালো আইন দিয়ে কুইক মানি বানানোর জন্য সমমনা ব্যবসায়ীদেরকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু দায়মুক্তি আইন না করলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দেয়া হলে ব্যয় অনেক কমে যেতো। দ্বিতীয়ত, শুধু একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়; কিন্তু এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করা হয়নি।
রহমতুল্লাহ বলেন, ২০১৩ সালে প্রতিবেশী দেশের সাথে আমাদের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে তা উদযাপনও করেছিল; কিন্তু বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়নি। অথচ মিয়ানমার ২০১৪ সাল থেকেই আমাদের পাশের (১২ নম্বর ব্লক) গ্যাস ব্লক অর্থাৎ ১১ নম্বর গ্যাস ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য কাজ শুরু করে। ২০১৮ সাল থেকে তারা বিপুল গ্যাসের মজুদ পায়। ওই বছর থেকেই তারা বাণিজ্যিকভাবে চীন ও ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে। অথচ ১০ বছর পার হয়ে গেলেও সমুদ্র থেকে আমাদের গ্যাস উত্তোলনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আজ গ্যাস উত্তোলন করা হলে জ্বালানি সঙ্কটে পড়তে হতো না।
পাওয়ার সেলের সাবেক এই ডিজি বলেন, সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা বলছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুঁটি বসানো হয়েছে আর তার টানানো হয়েছে; কিন্তু এসব লাইন নিয়মিত মেইনটেনেন্স করার সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। এমনকি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক হবে কি না তারও কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। এর ফলে ভর্তুকির বোঝা চাপছে জাতির ঘাড়ে। তিনি মনে করেন, এখান থেকে উত্তরণের একটাই উপায়, আর তা হলো প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি এ খাতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি দ্রুত বন্ধের ব্যবস্থা করা।
এ দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে গত কয়েক মাস যাবৎ ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। বলা হয়েছিল মাস দুয়েকের মধ্যেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে; কিন্তু এখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাই ডলারের সঙ্কটের কথা বলে দিনে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছেন।
এক দিকে ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং, অপর দিকে গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্পকারখানার চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেকেই লোকসান দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে পণ্য উৎপাদন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। টেক্সটাইল খাত ভয়াবহ সমস্যার মুখে পড়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে; কিন্তু এর কোনো সমাধানের আশা কেউ শোনাচ্ছেন না। বরং হতাশার কথাই ব্যক্ত করা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও কৌশল, আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বয়ের অভাব ও স্বজনতোষণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। যুদ্ধের ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে এ কথা সঠিক; কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বা ওঠানামা নতুন কিছু নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অপচয়। ফলে সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না, তারা জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ডলার পাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে এবং ক্যাপাসিটি পেমেন্টের দায় বাড়ছে। বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা।
এসব কিছু মিলিয়েই মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং, সীমাহীন জনদুর্ভোগ এবং দেশীয় ও রফতানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে। দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে এসব আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার নিজেদের কল্পিত সাফল্য নিয়ে এতটাই আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল যে এসব সতর্কবার্তায় তারা কান দেয়নি। বলা যায়, অতীতের দুষ্কর্ম এখন সরকারকে ভোগাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য তারা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, দেশীয় কয়লার মজুদ ব্যবহার বাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।