পড়ার চাপে অবসাদে ভুগছেন ৭৬ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬:৪৬ পিএম, ৮ অক্টোবর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:০০ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
করোনা-পরবর্তী পড়াশোনার চাপ, হতাশা ও সেশনজট শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা কার্যক্রমের চাপে অবসাদে ভুগছেন প্রায় ৭৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৪০৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে করোনার সময় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ১৫ মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৫১ জন শিক্ষার্থী। গতকাল শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি জানিয়েছে, সংখ্যাগত তথ্য তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার সংবাদ থেকে সংকলিত করেছে। এর ভিত্তিতে তারা আত্মহত্যার পেছনের কারণ বুঝতে ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শিরোনামে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থী ছিলেন যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৬ শতাংশ। প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছেন।
জরিপে উঠে এসেছে, করোনা-পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত পড়াশোনা এবং কম সময়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যক্রম শেষ করার জন্য এক ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এটা ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যবর্তী সময় এবং মানসিক চাপ কাটিয়ে ওঠার সুযোগ কম থাকায় ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসায় ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে। শিক্ষাজীবনে বাধা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পড়াশোনা এবং সিলেবাস দ্রুত শেষ করার চাপে প্রায় ৬৭ শতাংশের জীবন প্রভাবিত হয়েছে বলেও জরিপে উঠে আসে। জরিপে ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা বিভিন্ন মেয়াদে সেশনজটের শিকার হয়েছেন। প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাঁরা ন্যূনতম এক বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল ওহাব। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, বেঁচে থাকার সংকট এখন বেড়ে গেছে। কারও কারও কাছে দুঃখ-কষ্ট যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন মৃত্যুকে শ্রেয় মনে হয়। এ ধরনের মানুষ যদি কারও সঙ্গে তার কষ্টের কথাগুলো ভাগ করে নিতে পারেন, তাতে তার কষ্ট কমে। এ কারণে অন্যের কষ্টের সময় পাশে দাঁড়াতে হবে। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেকের যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর মতো দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান বলেন, তরুণ বয়সে প্রাণবন্ত থাকার কথা। তাহলে কোনো কোনো তরুণ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, তার পেছনের কারণগুলো বের করে সমাধান করতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের মানসিক সমস্যার সময় প্রতিকারের জন্য কোথাও যেতে পারছেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলরের অভাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা নিরসনে পাশে দাঁড়াতে পারছে না। সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, মাত্র ৯ মাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এটা উদ্বেগজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, মনখুলে কথা বলার মতো সামাজিক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলের শিক্ষার্থী বেশি : গত ৯ মাসে আত্মহত্যা করা ৪০৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২১৯ জনই স্কুলের। এ ছাড়া ৮৪ জন কলেজ শিক্ষার্থী, ৫৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং মাদ্রাসার ৪৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪২ জন নারী ও ১৬২ জন পুরুষ।
৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে চাপে : জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, প্রায় ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা করোনা-পরবর্তী একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমের চাপের কারণে বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও গঠনমূলক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের এসব মানসিক অবসাদের পেছনে দায়ী কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ বিরতির কারণে সৃষ্ট সেশনজট, পড়াশোনায় অনীহা, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশা ও শিক্ষাঙ্গনে পঠিত বিষয় বুঝতে না পারা। ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেন, করোনার আগের তুলনায় পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে গেছে। ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেন, তাদের ঘন ঘন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর সঙ্গে তারা খাপ খাওয়াতে পারছেন না। পরীক্ষার সময়ের চেয়ে সিলেবাসের আধিক্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশ শিক্ষার্থীর। প্রায় ২১ শতাংশ বলেছেন, স্বল্প সময়ে এত বড় কোর্স শেষ করার ফলে তারা পড়া বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রায় ৭ শতাংশ বলেন, পড়াশোনার চাপের জন্য তারা পরিবারকে সময় দিতে পারছেন না। এটা তাদের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৮ শতাংশ বলেছেন, নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগ তাদের জীবন প্রভাবিত করেছে। পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তন যেমন মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তি আসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শিক্ষাজীবনে প্রভাব পড়ার কথা বলেছেন প্রায় ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ডিজিটাল ডিভাইস যেমন মুঠোফোন, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের ওপর অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মত দিয়েছেন ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী। অনেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। অভিভাবকদের অতিরিক্ত চাপও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। পরীক্ষার ফল ভালো না হওয়ার ভয়ে থাকেন তারা। আর প্রায় ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, ভবিষ্যৎ পেশাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক চাপে আছেন। প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেন, তারা নিজেদের মানসিক সমস্যাগুলো শেয়ার করার মতো শিক্ষক পান না। পড়াশোনার জন্য তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিবেশ সহায়ক নয়। তাই তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।