ফেনীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, সক্রিয় নারীসহ ২২টি গ্রুপ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৪৪ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:০৭ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ফেনীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। হত্যা, চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে উঠতি বয়সী এসব কিশোর। এদের অনেকের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। ফলে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শাসিয়ে তাদের বিপথ থেকে ফেরানো যাচ্ছে না।
এই গ্যাং কালচার দমনে জেলা পুলিশ সম্প্রতি ডাটাবেজ তৈরি করছে। বিষয়টি নিয়ে গত রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও ব্যাপক আলোচনা হয়।
এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, শহরের অধিকাংশ স্কুল-মাদরাসায় কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। অনুসন্ধানে একটি নারী গ্যাংসহ ২২টি গ্রুপের নাম পাওয়া গেছে।
অদ্ভুত ধরনের এসব গ্রুপের নাম হলো, এমডিবি ৩৬০ ডিগ্রি, এলএসকেবি, সেভেন স্টার, নাইন স্টার, আরডিভি, এক্স টেন, কেজিআরএক্স, এসডিকে, ডিএসবি, ডিডিবিএক্স টোয়েন্টি, এইচপিজিআর, এফডিকেটেন, টিআরডিএক্স, বিবিএক্স টেন, জেএসকেবি, জিএসকেবি, এসআরডিএক্স, এমডিবি কোড ১৮০, এমএসবিএক্স ও নারী গ্যাং এলবিবিজি।
এসব গ্যাংয়ের নিরাপদ আস্তানা ফেনী আলিয়া মাদরাসা মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা, কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড আয়কর অফিস সংলগ্ন এলাকা, নাজির রোড, শহরের শান্তি কোম্পানি রোড, মিজান রোড, একাডেমি, সালাহ উদ্দিন মোড়, পাঠানবাড়ী, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক, পুলিশ কোয়ার্টার, রামপুর, পশ্চিম উকিল পাড়া, সেন্ট্রাল হাই স্কুল, ডাক্তারপাড়া, পৌরসভা সংলগ্ন এলাকা ও মাস্টারপাড়া।
সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের সাথে খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে ছুরিকাহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যায় দাগনভূঞা উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের নুরুল্লাহপুর গ্রামের সজিব নামে এক কিশোর। তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি ফাজিলপুরে খেলা নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ফেনী শিশু নিকেতন স্কুলের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, শহরের বিভিন্ন স্কুলকেন্দ্রিক ও পাড়াকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যরা সবাই শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ পডুয়া শিক্ষার্থী।
এক গ্রুপের কোনো সদস্যকে মারধরের ঘটনা ঘটলে প্রতিশোধ নিতে কালক্ষেপণ করে না অন্য গ্রুপের সদস্যরা। এদের স্কুল ব্যাগে থাকে চাপাতি, পকেটে থাকে ক্ষুর। আধিপত্য বিস্তার, ছোট ভাই-বড় ভাই এবং প্রেমসংক্রান্ত বিষয়সহ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হলেই এরা মারামারিতে লিপ্ত হয়। এরা স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদেরও নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে।
ফেনী আলিয়া মাদরাসা মার্কেটের দোকান মালিক নুরুল হুদা বায়েজিদ জানান, তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না দোকান মালিকরা। তাদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন এ মার্কেটে লোকজন ও কাস্টমার আসা কমে যাচ্ছে। সকাল, বিকেল ও গভীর রাত পর্যন্ত এরা নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। এদের মাঝে মদ-গাঁজাসহ নানা ধরনের নেশার আসর বসে।
নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ফেনী শহরের শান্তিধারা কাজীপাড়া আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দা জানান, পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপের ইন্ধনদাতা রাজনৈতিক পরিচয়ধারী এলাকার বড় ভাইয়েরা। নিজেদের বিভিন্ন কাজে কিশোরদেরকে ব্যবহার করে এরা।
কিশোররা মামলা-হামলার শিকার হলে বড় ভাইয়েরা তাদের শেল্টার দিয়ে থাকে। ফলে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। এরা মাদক-ছিনতাই-ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
ফেনী সিটি গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এম মামুনুর রশিদ জানান, স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে পাড়া-মহল্লার মোড়ে দাঁড়িয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যরা ছাত্রীদের নিয়মিত উত্ত্যক্ত করছে। এ নিয়ে অভিভাবকরা রীতিমত উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, পুলিশের অভিযান টের পেলে এরা সরে পড়ে।
ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) নাদিয়া ফারজানা বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। নিজ নিজ থানা এলাকায় বিট অফিসারকে এ ব্যাপারে তথ্য দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অযথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে কোনো গ্যাং দ্বারা জনজীবনে বিশৃঙ্খলার তৈরি হচ্ছে- এমন প্রমাণসহ অভিযোগ চাওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের মনিটর করা হবে। কিশোর গ্যাং নতুন এক উপদ্রব। কেউ চাইলেই গ্যাং থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তবে, গ্রুপ থেকে বের হয়ে গেলে তার নামটি ডাটাবেজ থেকেও বাদ দেয়া হবে।