জলবায়ু পরিবর্তনে উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : জাইকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:২৩ পিএম, ২৯ আগস্ট,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:০৬ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাংলাদেশে নিয়মিত পাঁচ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় বলে মনে করে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাইকা। বন্যা, শহরে পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও ভূমিকম্পসহ আরো কয়েকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এ দেশের নিত্যসঙ্গী। উচ্চ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগে আগ্রহী এ উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি।
জাইকা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশের সামাজিক পরিবর্তন তো হচ্ছেই, সঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সেমিনারে এসব তথ্য প্রকাশ করে জাইকা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইউহো হায়াকাওয়া, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও প্রতিমন্ত্রী ড. সামসুল আলম। সংস্থাটির জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ একেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে একেকটি ঝুঁকি মোকাবেলা করছে। নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের কারণে জনসংখ্যার বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, দেশের বিশাল শিল্পগুলো ধ্বংসের মুখে পড়ে। এছাড়া অস্বাভাবিক বন্যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্টস ক্ষতির মুখে পড়ে।
জরিপে আরো বলা হয়, নদীভাঙন বাংলাদেশের নিয়মিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর একটি। এর ফলে ওই এলাকার মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ে, বিশাল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নদী তীরে তৈরি হওয়া অবকাঠামোগুলো ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। একই ঘটনা ঘটে শহর এলাকায় বন্যা হলে। এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ণের পরামর্শ দিয়েছে জাইকা। তারা বলছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ণয় করা। প্রয়োজনে জাইকার করা প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও বলছে তারা। জাইকা এক্ষেত্রে, ২১০০ সালের যে ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছে তার প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় কাজ করতে ইচ্ছুক। এর আগের করা এ ধরনের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে চায় তারা। পাশাপাশি তারা বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করা, পরিবেশ ও সামাজিক বিভিন্ন শর্তগুলো ভেবে দেখার কথাও বলছে।
জাইকার জরিপে দেখা যায়, নদীর কাছাকাছি থাকা জেলা বা অন্য শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট শহর, যা সুরমা নদীর তীরে। চট্টগ্রাম শহর ও এর আশপাশের এলাকা যা কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর কারণে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা আরেকটি শহর হলো- কক্সবাজার ও মহেষখালি এলাকা। এই শহরগুলো মাতামুহুরী ও বাঁকখালি নদীর তীরে অবস্থিত। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে উপকূলীয় কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তোলা হচ্ছে। মাতারবাড়ি ও মহেশখালি ডেভেলপমেন্ট এরিয়া ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকলেও এসব এলাকায় পাওয়ার প্ল্যান্টস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও উন্নয়ন কাজ চলছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম ও মিরসরাই এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পপার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এছাড়া এসব এলাকায় সেবা খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। তবে নোয়াখালীর দক্ষিণ অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় তাদেরও একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আঞ্চলিক হাব হিসেবে বরিশাল ও ভোলা এলাকায় আলাদা করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তৈরী হচ্ছে। এটি ওই অঞ্চলের অথনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জাইকার অর্থায়নে কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রজেক্ট, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট প্রজেক্ট, ঢাকা ও রংপুরে রাডার সিস্টেম উন্নয়নে প্রকল্প ইত্যাদি। এ প্রকল্পগুলো ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, উপকূলীয় উন্নয়ন এলাকাগুলোতে দুর্যোগ পূর্ববর্তী বিনিয়োগ বাড়ানো যাতে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায়, চলমান অবকাঠামোগুলোর গুণগত মান উন্নত করা আবশ্যক। তবে বাংলাদেশে এখনও অনেক কম পরিমাণে মেইনটেইনেন্স বাজেট হয়। ফলে প্রকল্পগুলো তৈরি হওয়ার পর বেশিদিন টিকে না। ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা। এখানে ভূমিকম্প হলে জনসংখ্যার পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে ‘চট্টগ্রাম শহর নিয়ে। ভূমিকম্প হলে ঢাকায় যেসব ক্ষতি হতো চট্টগ্রামেও একই ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সবেচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শহরের মধ্যে রয়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকা। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব এলাকায় জাইকার অর্থায়নে দশ বছর মেয়াদি ৫টি প্রকল্প চলছে। জাইকা পরামর্শ দিয়ে বলছে, তিনটি ধাপে বাংলাদেশ পদক্ষেপ নিতে পারে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত অল্প সময়ের পদক্ষেপ, ২০৩০ সাল নাগাদ মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ এবং ২০৪০ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি নির্ণয় করার প্রকল্প নেয়ার পাশাপাশি দুর্যোগের পূর্বে বিনিয়োগে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। মধ্যমেয়াদি সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবেলায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়ানো। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে ২০৪০ সাল পর্যন্ত দুর্যোগের আগে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং এটি চালিয়ে যাওয়া। আগাম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ প্রতিষ্ঠানটির।
পানির কারণে সংঘটিত দুর্যোগপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি এলাকায় বিনিয়োগে আগ্রহী জাইকা। নদীর কাছাকাছি এলাকাগুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরাঞ্চলের বন্যা প্রবণ এলাকা, পদ্মা ও যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে। শহর এলাকাগুলোর মধ্যে, ২১০০ সালের ডেল্ট প্ল্যানে থাকা বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল এলাকা। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ি ও মিরসরাই এলাকায় বিনিয়োগে আগ্রহী জাইকা। ভূমিকম্প মোকাবেলায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকা ও সুশাসনের জন্য বাংলাদেশের যেকোনো এলাকায় বিনিয়োগে আগ্রহী তারা।