ইভিএম একটি নিকৃষ্ট যন্ত্র : বদিউল আলম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:২৫ পিএম, ৫ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৭ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) একটি নিকৃষ্ট যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর সেগুন বাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তথ্যের বিশ্লেষণ উপস্থাপনের লক্ষ্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সংবাদ সম্মেলনে থেকে এ কথা জানানো হয়।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমার কাছে বড় প্রশ্ন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা। নির্বাচন কমিশন তাদের সক্ষমতা প্রদর্শন করে আইন-কানুন বিধি-বিধান প্রয়োগের মাধ্যমে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে, চুনোপুঁটিদের ক্ষেত্রে তারা আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে আইন প্রয়োগ করেছে, রাঘব বোয়ালদের ক্ষেত্রে তারা আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আত্মসমর্পণ করেছে। নির্বাচন কমিশন যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে নাগরিকরা যাবে কোথায়। আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনান্য কমিশনার কতগুলো বিষয়ে পরস্পরবিরোধী এবং অসংলগ্ন বক্তব্য দিয়েছেন। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে আমাদের আশংকা।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম কাঠগড়ায় ছিল। ইভিএম বিষয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছিল ৬টি আসনে আর ২৯৪টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল পেপার ব্যালটে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী ২৯৪ আসনে যেখানে পেপারব্যালটে ভোট হয়েছে, সেখানে ভোট পড়েছে ৮১ শতাংশ। অন্যদিকে যে ছয় আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছে সেখানে ভোট পড়েছিল ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ পার্থক্য, তার মানে যেখানে পেপার ব্যালটে ভোট হয়েছে সেখানে কারসাজি করা হয়েছে, না হয় যেখানে ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে মানুষকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইভিএম যদি মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সেই ইভিএম ব্যবহারের যৌক্তিকতা কি? ২০১৭ সালে কুমিল্লায় পেপার ব্যালটে ভোট পড়েছিল ৬৪ শতাংশ। এবারে সেখানে ভোট পড়েছে ৫৯ শতাংশ। ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে, বায়োমেট্রিক ছাপ না মেলায় অনেকে বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। এখানে ইভিএম মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
তিনি বলেন, যে কোনো যন্ত্র যা সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত হয়, তাতে কারসাজি করা যেতে পারে। যারা প্রোগামিং করে তারাও কারসাজি (ভোট ডাকাতি) করতে পারে। আবার যেহেতু নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওভার রাইটিং-এর ক্ষমতা দেয়া আছে, তারাও কারসাজি করতে পারে। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে এই ইভিএম একটা নিকৃষ্ট যন্ত্র, এটা প্রতিষ্ঠিত। পেপার না থাকার ইভিএমে নির্বাচন কমিশন যে তথ্য দেবে আমাদেরকে তাই গ্রহণ করতে হবে। ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে, এর পেছনের লোকের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপরে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়, ২০২৩ সালের শেষে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জনগণ চায় এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হোক। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা না ফিরলে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কখনই সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফেরানোর প্রয়োজনেই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে, যথাযথ তদন্ত করে এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে তাদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে হবে।
দিলীপ কুমার সরকার তার প্রবন্ধে বিজয়ীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাত তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন বিএ। ৩৭ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে যে ৩৬ জনের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীর সংখ্যা ১৭ জন (৪৭.২২%)। পক্ষান্তরে এসএসসি এবং ও তার চেয়ে কম শিক্ষাগত স¤পন্ন জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৯ জন (২৫%)। ২০১৭ সালের নির্বাচনের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ২০১৭ সালের তুলনায় এবারে স্বল্পশিক্ষিতদের (এসএসসি ও তার নিচে) নির্বাচিত হওয়ার হার বেশ কম। অপরদিকে উচ্চ শিক্ষিতদের (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) নির্বাচিত হওয়ার হার বেশি। প্রবণতাটি ইতিবাচক। বিজয়ীদের পেশা স¤পর্কে তিনি বলেন, নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাত পেশার ঘরে লিখেছেনঠিকাদারী, গৃহস¤পত্তি আয় ও ব্যাংক সুদ আয়। আয়ের উৎস খাত অনুযায়ী ব্যবসা থেকেই তার আয় বেশি। সে অনুযায়ী তার পেশা হয় ব্যবসা। তথ্য পাওয়া নবনির্বাচিত ২৬ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ২১ জনই (৮০.৭৭%) ব্যবসায়ী। অন্যদিকে নবনির্বাচিত ৯ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ৭ জনই (৭৭.৭৮%) গৃহিণী। মামলা সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাতের বিরুদ্ধে বর্তমানে কোনো মামলা নেই; তবে অতীতে একটি মামলা ছিল। অতীতের মামলাটির অভিযোগসমূহের মধ্যে ৩০২ ধারার অভিযোগও ছিল। তথ্য পাওয়া নবনির্বাচিত সর্বমোট ৩৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১৩ জনের (৩৬.১১%) বিরুদ্ধে বর্তমানে, ১৩ জনের (৩৬.১১%) বিরুদ্ধে অতীতে এবং ৬ জনের (১৬.৬৭%) বিরুদ্ধে উভয় সময়ে মামলা আছে বা ছিল। ৩০২ ধারায় ৩ জনের (৮.৩৩%) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ৪ জনের বিরুদ্ধে (১১.১১%) অতীতে মামলা আছে বা ছিল। নবনির্বাচিতদের আয় ও স¤পদের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, তথ্য পাওয়া নবনির্বাচিত সর্বমোট ৩৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ২০ জনের (৫৫.৫৬%) বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার কম এবং ১১ জনের আয় (৩০.৫৬%) ৫ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা। তথ্য পাওয়া নবনির্বাচিত সর্বমোট ৩৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১১ জনের (৩০.৫৬%) স¤পদের পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকার কম। কোটিপতি রয়েছেন ৬ জন (১৬.৬৭%)।
কুমিল্লা নির্বাচন স¤পর্কে সুজন-এর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্বাচনি এলাকায় শোডাউন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে কিছু কিছু প্রচার-প্রচারণা এবং ভোটের আগের রাতে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ছাপিয়ে মূল আলোচিত ঘটনা ছিল কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি। সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর ২২ ধারার অধীনে কমিশন ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও তিনি সে নির্দেশ উপেক্ষা করে এলাকায় অবস্থান করেন। নির্দেশ অমান্য করা সত্ত্বেও বিধিমালার ৩১ ও ৩২ ধারা অনুযায়ী শাস্তির বিধান প্রয়োগ না করায় কমিশন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে কমিশন থেকে বলা হয় বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এই ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি কমিশনের মর্যাদাও ক্ষুণœ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা না ফিরলে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কখনই সম্ভব নয়। তাই, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফেরানোর প্রয়োজনেই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে, যথাযথ তদন্ত পূর্বক এ স¤পর্কে নির্বাচন কমিশনকে তাদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যগুলোর সঠিকতা যাচাইয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্যও আমরা কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ হলফনামায় তথ্য প্রদানের মূল উদ্দেশ্য হলো তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতায়িত করা। তথ্য যদি সঠিক না হয় তাহলে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। আশা করি নির্বাচন কমিশন আমাদের আহবানে সাড়া দেবে।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, কুমিল্লা নির্বাচন ছিল এই কমিশনের প্রথম পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষাতেই তারা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইভিএমে প্রিন্টআউট না থাকার কারণে পুনঃগণনার সুযোগ নেই। যারা ইভিএমে ভোট দিতে না পেরে ফেরত যান, তাদের জন্য বিকল্প ভোটের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সরকারি লোকজন যদি সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে পদত্যাগ করার সাহস ও দৃঢ়তা দেখাতে হবে। কমিশন এই দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের মূল অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও এখন আলাপ শুরু করতে হবে।
একরাম হোসেন বলেন, কুমিল্লা নির্বাচনে নাগরিকদের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কয়েকটি কারণ আছে। একটি হলো সমাজকর্মীদের স্কুলে ব্যবসায়ীরা অধিকহারে নির্বাচিত হচ্ছেন অপরটি হলো মামলা সংশ্লিষ্টরাও নির্বাচিত হচ্ছেন বেশি করে। খুনের মামলার আসামিও আছেন অনেকে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার, জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।