জিয়ার অর্থনৈতিক চিন্তা ও আধুনিক বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫১ পিএম, ৪ জুন,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৪৩ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর নতুন সংবিধান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকরের উপযোগী কোনো ধারণা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের কারো মাথায় ছিল না। এমনকি এ বিষয়ক কোনো প্রস্তুতিও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির ছিল না। গণপরিষদে যখন এ বিষয়ক বিতর্ক হয় তখন সমাজতন্ত্রকে ‘মুজিববাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়। বস্তুত মুজিব নিজে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা দিলেও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি স্বাধীনতার পরপরই সকল পাট ও বস্ত্রকলগুলো জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু কোনোরূপ পূর্বপ্রস্তুতি এবং স্বচ্ছ ধারণা ব্যতিরেকেই তার এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। বস্তুত জাতীয়করণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর সফল বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণের প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ একটি সৎ রাজনৈতিক দল, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী এবং বিশ্বস্ত প্রশাসন- এই তিনের সমন্বয় ব্যতীত একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উত্তরণ ছিল অসম্ভব। কিন্তু মুজিবীয় আমলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির এই প্রধান নিয়ামকসমূহ গড়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু যারা বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছিলেন তাদের এ সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানও ছিল না। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল। জাতীয়করণের সুযোগে প্রভাবশালী মহল লুটপাটের সুযোগ পেয়ে গেল এবং অতিদ্রুত বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা লাভ করলো। এসব কারণে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরেই বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার উপক্রম হলো। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ‘বটমলেস বাস্কেট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই দুর্যোগ রাজনীতিতেও সংক্রমিত হলো। একটি ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব ঘটলো। সাধারণ সৈনিক এবং জনগণই জিয়াকে কাঁধে করে ক্ষমতার দোরগোড়ায় নিয়ে এলেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জিয়া উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।
জিয়ার অর্থনৈতিক ভাবনা ও উন্নয়ন নীতি : জিয়া ব্যক্তিখাতের প্রাধান্যসহ মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তার লক্ষ্য ছিল, জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার উন্নত করা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন। এ দুইটিকে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করতেন। উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর লক্ষ্যে তিনি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন : ১. সরকারি ও বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পদের ভিত্তিতে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানো, ২. বিনিয়োগমূলক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো, ৩. জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি তথা কৃষি ও শিল্প খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পদের বরাদ্দ বাড়ানো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গ্রামমুখী অর্থনীতির উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ অর্থ গ্রাম। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য আমাদের গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে।’ গ্রামীণ জনজীবনের সার্বিক উন্নতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের নিরক্ষর ও দরিদ্র মানুষের দ্বারে আমাদের সভ্যতার বাণী নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বলতে পারবো যে, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমরা কাজ করেছি।’ ১৯৭৬ সালের ৬ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আলাপকালে জিয়া তাঁর উন্নয়ন নীতির রূপরেখা তুলে ধরেন : ১. উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, ২. গ্রামকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে, ৩. গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং ৪. পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের কাজে জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে তিনি বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের রূপরেখাও দিয়ে গিয়েছেন।
দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা : মুজিব সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও সীমাহীন লুটপাট এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে জিয়া একটু দম নিতে চাইলেন। তাই তিনি একটি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এই পরিকল্পনায় জিয়ার ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতিফলন ঘটানো হয়। পরিকল্পনা প্রণয়নের খসড়া নিয়ে তিনি ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অর্থনীতি সমিতির একটি তিনদিনের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘জনগণের জন্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে দেশে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে অব্যাহতভাবে অনুসরণ করতে হবে। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জনশক্তির কার্যকর ব্যবহার এবং উর্বর জমি, পানি, গ্যাস ইত্যাদির মত অবিকশিত ও অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।’ দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল, উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং এ কারণে কৃষি উন্নয়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। এ পরিকল্পনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা এবং বাণীজ্যিক জ্বালানি উন্নয়নের উপর জোর দেয়া হয়। দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ পরিকল্পিত ব্যয়ভারসহ বহুসংখ্যক চলমান প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ সে সময় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষিখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে কৃষিপদ্ধতির দ্রুত রূপান্তরের জন্যে আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি প্রসারিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে একটি মূলধনভিত্তিক কাজ বিবেচনায় নিয়ে সৌর ও বায়ুশক্তির মতো প্রাকৃতিক শক্তির উৎসসমূহের উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়। দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে নিরাময়মুখী থেকে প্রতিরোধমুখী করার উদ্যোগও এই পরিকল্পনার মেয়াদেই গৃহীত হয়।
১৯৮০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে জিয়া দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নয়টি অগ্রাধিকারমূলক উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেন : ১. খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, ২. শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ৩. জনশক্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ৪. সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, ৫. গণস্বাক্ষরতা কার্যক্রম প্রবর্তন, ৬. কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করা, ৭. গ্রামাঞ্চলে মৌলিক চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারিত করা, ৮. উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং ৯. সমবায় পদ্ধতির সম্প্রসারণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন।
ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব : খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর গভীর আন্তরিকতা থেকেই জিয়া ভূমি সংস্কারে আগ্রহী হন। তিনি মনে করতেন, উত্তরাধিকার আইনের অধীনে ক্রমাগতভাবে জমি খণ্ডবিখণ্ড হওয়া, নিরক্ষরতা ও সার ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, যান্ত্রিক চাষাবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, ঋণ প্রদানকারী মহাজনদের শোষণ ইত্যাদির ফলেই কৃষকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। জিয়া সীমানা হিসেবে ব্যবহৃত আইল প্রথার সমালোচনা করতেন। তৎকালীন এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে জমির যত আইল আছে তা একত্র করলে একটি জেলার সমপরিমাণ জায়গা বের হয়ে আসবে।
১৯৮০ সালে জিয়ার শাসনামলে জাতীয় সংসদে এক বৈঠকে ভূমি ও কৃষি সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবের প্রথম সুপারিশ ছিল, গ্রামাঞ্চলে পরিবার প্রতি কৃষিজমির ঊর্র্ধ্বসীমা ১০০ বিঘা রাখা যেতে পারে; কিংবা মাথাপিছু ১০ বিঘা করা যেতে পারে। শহরাঞ্চলে কোনো ব্যক্তি একটির বেশি প্লট বা আধাবিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। এর বেশি রাখলে তা অধিগ্রহণ করে প্রকৃত শহরবাসীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। প্রস্তাবে একটি বর্গাচাষ আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও খাসজমির ব্যবস্থাপনা, নদী সিকস্তি ও নদী পয়স্তি জমির জন্য আইন প্রণয়ন এবং ভূমিকরের জাতীয় হার নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট বিধান সুপারিশ করা হয়।
বেসরকারি বিনিয়োগ : শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তিনি ব্যক্তিখাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছেন। ব্যক্তিখাতকে ব্রিজ ফাইন্যান্সিং ও আন্ডাররাইটিং সুবিধা প্রদান এবং দেশীয় বেসরকারি শিল্প ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে সহযোগিতার ওপর থাকা সকল বাধা-নিষেধ বিলোপে তিনি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রতিষ্ঠা করেন। বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার জন্য তার সরকার ১৯৭৬ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুনঃসক্রিয় করার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জিয়া সরকার জাতীয়করণ করা ২৯টি চা বাগান ব্যক্তিখাতে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৮ সালের মধ্যে সরকার ১১৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে। বেসরকারি নিনিয়োগ নীতিতে জিয়া সরকার দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারকারী রপ্তানীমুখী শিল্প, গ্রাম ও অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপন, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প স্থাপনকে স্বাগত জানায়।
নারী উন্নয়ন : শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নারী উন্নয়নের বিকল্প নেই। মোট জনসমষ্টির এই বিরাট অংশকে পিছিয়ে রেখে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই জিয়া নারী উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। নারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। দেশের নারীদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের মাধ্যমে সৃজনশীল কর্মকান্ড ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৬ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক বছরের মধ্যেই ১৯৭৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় মহিলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়া পুলিশ বাহিনীতে নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেন। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ সর্বপ্রথম পুলিশে নারীদেরকে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। তার আমলেই আনসার ও ভিডিপিতেও নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংসদীয় আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় জিয়ার আমলে।
জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধারা দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও অব্যাহত থাকে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য পদ সংরক্ষণসহ ১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল সরকারি চাকরিসমূহে নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়াও চাকরিতে প্রবেশের জন্য মেয়েদের বয়সসীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয় ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর তারিখে।
ব্লুু ইকোনমি : উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে ব্লু ইকোনমির ভূমিকা অপরিসীম। ব্লু ইকোনমি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমুদ্রের উপযোগিতা বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে, খনিজ সম্পদ আহরণ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী হয়েছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সমদ্রকেন্দ্রিক এই ব্লু ইকোনমির পথিকৃৎ। তার উদ্যোগে ১৯৮১ সালের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশ সেরা একদল মেধাবী শিক্ষার্থী এবং বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ একটি শিক্ষা সফর আয়োজন করে। সমদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে এই ব্যতিক্রমধর্মী সফরে জিয়া অংশগ্রহণকারীদের সাথে মতবিনিময় করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ ও সম্ভাবনার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
খালখনন কর্মসূচি : ১৯৭৬ সালের নভেম্বরের এক শীতের সকালে জড়ো হওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের কোলাহলে ঘুমন্ত গ্রাম উলশী জেগে উঠে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে মিলে সর্বপ্রথম মাটিতে কোদালের কোপ বসান। তাঁকে অনসরণ করেন গ্রামেরই ৭০ বছর বয়সী আবদুর রহমান বাদ্যকর। এই বৃদ্ধ তার নিজের এক একর জমি খালের জন্য দান করেন। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধনের উপযোগী জিয়ার খালখনন কর্মসূচির সূচনা এভাবেই। জিয়া উলশী-যদুনাথপুর এলাকাকে ‘সারথী স্বনির্ভর এলাকা’ নাম দিয়েছিলেন।
গ্রাম সরকার : সরকারের উন্নয়নকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকে জিয়াউর রহমান গ্রাম সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। গ্রাম সরকারের লক্ষ্য কেবল উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাই ছিল না; বরং নিম্নতম স্তর পর্যন্ত প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্যেও গ্রাম সরকার অপরিহার্য ছিল। গ্রাম সরকার পরিকল্পনার অধীনেই বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ১৯৭৭ সাল থেকে ভূমিহীন নারী ও পুরুষদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ১৯৮০ সালের ৩০ মে সাভারের জিরাবো গ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়া সর্বপ্রথম গ্রাম সরকারের উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সালে ৭ জানুয়ারি ঢাকায় স্বনির্ভর গ্রাম সরকার প্রধানদের নিয়ে তিনি একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন। কনভেনশনে তিনি বলেন, ‘গ্রাম সরকারদের দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।’ এই কনভেনশনে তিনি গ্রাম সরকারগুলোর জন্য পঞ্চবার্ষিক পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, সরকারি খাসজমিতে ফলের গাছ রোপণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণসহ বিশটি কাজের একটি তালিকা দেন।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত : বাংলাদেশের জিডিপিতে দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। এ শিল্পের ভিত এবং মূল মানবসম্পদের ভিত গড়ে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই অধুনালুপ্ত দক্ষিণ কোরীয় শিল্প গ্রুপ দেইউ-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দেশ গার্মেন্টস স্থাপনের চুক্তি করা হয়। এরপর ১৩০ জন তরুণ-তরুণীকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতের উপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণের জন্যে দক্ষিণ কোরিয়ার পুসানে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭৮ সালে জিয়ার শাসনামলেই এই স্কিম চালু হয়। এটি চালু করার ফলে রফতানিকারকেরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায়।
জনশক্তি রফতানি : বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রেখে চলেছে এরকম আরেকটি বড় খাত হচ্ছে রেমিট্যান্স। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাত ধরেই এর শুভ সূচনা ঘটে। দেশের কর্মক্ষম যুবকদের চাহিদা পূরণের জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৬০৭৮ জন বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গমন করে। সেই থেকে এই ধারা ক্রমবর্ধমান আকারে অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি এই খাতের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে প্রণোদনা : দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বেই সমাদৃত। এ প্রকল্পের কারণে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন, যা আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পেছনে চাপা পড়ে আছে জিয়ার অবদান। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারির জোবরা গ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. ইউনূস পল্লী ব্যাংকিংয়ের একটি মাঠ পর্যায়ের গবেষণা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, প্রান্তিক জনগণের মাঝে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। পাইলট প্রকল্পটি সফল হবার পর বৃহৎ পরিসরে চালু করার ক্ষেত্রে বড় ফান্ডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনে তখন এগিয়ে আসেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁর নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। প্রাপ্ত ফান্ড ব্যবহার করে ড. ইউনূস চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলে সফলভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করেন। এরপরে আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। সে সময়ে উদ্যোক্তাদেরকে সরকারি ফান্ড থেকে টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্ভাবনা বিচারে জিয়া ঝুঁঁকিটা নিয়েছিলেন।
নোবেল পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ জন ক্যানেথ গ্যালব্রেইথ (১৯০৮-২০০৬) বলেন, 'In economics, hope and faith coexist with great scientific pretension and also a desire for responsibility.' বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তায় এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। জিয়া তাঁর যুগান্তকারী ১৯-দফা কর্মসূচিতে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর যে চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, আজ অবধি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তা ধারণ করতেন। তারই দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে জোর দিয়ে এসেছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখবে বলেই জাতি প্রত্যাশা করে।
জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তিনি ব্যক্তিখাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করেছেন। ব্যক্তিখাতকে ব্রিজ ফাইন্যান্সিং ও আন্ডাররাইটিং সুবিধা প্রদান এবং দেশীয় বেসরকারি শিল্প ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মধ্যে সহযোগিতার ওপর থাকা সকল বাধা-নিষেধ বিলোপে তিনি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রতিষ্ঠা করেন।
লেখক : ফারহান আরিফ, সদস্য-আহ্বায়ক কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।