৫৫ বছর বয়সে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবেন বেলায়েত শেখ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:৪২ পিএম, ২০ মে,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের বেলায়েত শেখ। তাঁর বাবা মৃত হাছেন আলী শেখ ও মা জয়গণ বিবি দম্পতির ছেলে। সাংসারিক ও পারিবারিক যাতনায় তার শিক্ষাজীবন খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করে হাল ধরতে হয়েছিল পরিবারের। কিন্তু শিক্ষার অপূর্ণতায় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। এরই একপর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন।
সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে তিনি ২০১৯ সালে রাজধানীর বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃত্বিতের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর থেমে যাননি তিনি, চলতি বছর তিনি এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেন ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে।
সবশেষ ৫৫বছর বয়সে আগামী জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন বেলায়েত শেখ। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। দৈনিক করতোয়া পত্রিকার শ্রীপুর হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি, এছাড়াও অনলাইন টেলিভিশন জেটিভি’র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তার স্বপ্ন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনার।
বেলায়েত জানান, ১৯৬৮ সালে তার জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে অভাব দেখেছেন। এর মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। অভাবের তাড়নায় ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।
তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালের আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন বাবার অসুস্থতা এবং অভাবের তাড়নায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে পরীক্ষা দিতে চাইলাম। সে বছর শুরু হলো বন্যা। ১৯৯০ সালেও পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। সে সময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের কথা ভেবে বিয়ে করি। বাবার তখনও অভাব ছিল। সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। ২৫-২৬ বছর একাধারে আমিই সংসার চালিয়েছি। এসএসসি দিতে না পারায় মেকানিক্যাল কোর্স করেছিলাম। মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপ ছিল। সেই ওয়ার্কশপ চালিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে। ভাই-বোনদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। কিন্তু তারপরও তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না করতে পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে। এই সময়ে আর লেখাপড়ারও সুযোগ পাইনি।
বেলায়েত শেখের তিন সন্তান। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম ছেলের জন্ম। বিরতি দিয়ে সে এখন গাজীপুরের একটি কলেজে অনার্সে পড়ছে। মাওনা চৌরাস্তায় তাকে স্যানেটারির দোকান করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তাকে বিয়েও করিয়েছেন। একমাত্র মেয়ের জন্ম ১৯৯৯ সালে। ইচ্ছে ছিল তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। সেজন্য রাজধানীর নামকরা কলেজে ভর্তিও করিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে সেখানে পড়াশোনা না করেই গ্রামে চলে আসে। সেখানে এইচএসসি শেষে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়েছে। এরপর তার বিয়ে দেন। তার ছোট ছেলের জন্ম ২০০৫ সালে। সে এ বছর বেলায়েত শেখের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেছে।
বেলায়েত শেখ বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল সন্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। অনেক আশা ছিল তাদের নিয়ে। কিন্তু তিন সন্তানের কেউই তা পূরণ করতে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি আর ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশায়।
তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষার জন্য শুরুর দিকে প্রস্তুতি নিইনি। তবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ায় বাড়তি ভালো লাগা কাজ করল। ভাবলাম, আমি চাইলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারব। আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও আমাকে পড়ালেখার সুযোগ দিচ্ছে। এরপর শ্রীপুরের মাওনায় ঢাকা থেকে পরিচালিত একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছি। আমার তো বাবা নেই, মারও বয়স হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে অভিভাবক হিসেবে কাউকে যাওয়া লাগতে পারে। এসব চিন্তা করে বড় ছেলেকে অভিভাবক দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বয়স চল্লিশ পার হলে পড়া আর মাথায় ঢোকে না। আমি পড়তে গেলে পড়া সহজে মুখস্থ হয় না, কষ্ট হয়। এজন্য পড়াগুলো আমি বারবার লিখি। লিখতে লিখতে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করি। বাকিটা আল্লাহর দান আর মানুষের দোয়া। সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমার চুল পেকে গেছে। সেজন্য চুলে কালি দিই। বয়স বেশি হলেও নিজেকে মনের দিক থেকে তরুণ ভাবতে পছন্দ করি। ৫৫ বছর বয়সে আগামী ১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সকলের কাছে দোয়া চাই।