‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের ১৩ অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০৭ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০১:২৩ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। আর এসব অভিযোগ এনেছে কমিশন নিজেই। যদিও এই কমিশনই এক সময় ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তার বিশেষণ দিয়েছিল চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিনকে।
গতকাল রবিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সামনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
এর মধ্যে কমিশনের নিয়ম না মেনে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ পরিচালনা করা, অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন চালানো, আলামত হিসেবে জব্দ করা ৯৩ লাখ টাকা নিজের কাছে রেখে দেওয়া, রিটের ভুয়া আদেশ দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করানো, বদলির পর নতুন কর্মস্থলে যোগদানে বিলম্ব করা এবং নথি বুঝিয়ে না দেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে দুদক সচিবের আনা ১৩ অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন শরীফ উদ্দিন। তাতে তিনি বলেছেন, অভিযোগের সবকিছু সত্য নয়। হাইপ্রোফাইল লোকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করায় তাকে প্রাণনাশের হুমকির বিষয়টি ৬ ফেব্রুয়ারি সচিবকে লিখিতভাবে জানানো হয়। যদিও সচিব গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘হুমকির বিষয়টি আমরা পত্রিকায় দেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি।’ সচিব বলেন, ‘গণমাধ্যম একপেশে সংবাদ পরিবেশন করছে। শরীফের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।’ তবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কেন তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো, এমন প্রশ্নের উত্তর আসেনি।
লিখিত বক্তব্যে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, শরীফ উদ্দিনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বহু অভিযোগ কমিশনে থাকায় তাকে অপসারণ করতে হয়েছে। চাকরি বিধিমালার ৫৪ (২) বিধিতে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অপসারণের বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি অনুযায়ী দুদক ছাড়া দেশের অন্যান্য অনেক দপ্তরেও এ রকম আইন ও বিধি আছে। কমিশনের শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে বিস্তারিত আলোচনা শেষে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অপসারণের আদেশ জারির পর থেকে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচারিত হচ্ছে। সচিব অভিযোগ করেন, একতরফা তথ্যের ভিত্তিতে এসব সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, যা প্রকৃত ঘটনার বিপরীত বলে দাবি করেন তিনি। দুদক সচিব বলেন, প্রভাবশালীদের চাপে অন্যায়ভাবে তাকে অপসারণ করা হয়েছে বলে তিনি (শরীফ) যে দাবি করেছেন মিডিয়ায় তাই প্রচার করা হয়েছে, যা প্রকৃত ঘটনা নয়।
তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু মামলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি উদ্ঘাটনের কারণে তাদের প্রভাবে শরীফকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছেÑ এটা মোটেও সত্য নয়। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, দুদক কোনো প্রভাব আমলে নেয় না। প্রভাবিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
দুদকের গোপনীয় প্রতিবেদনে শরীফ উদ্দিনকে ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন এত অভিযোগ কেন এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, দুদকে যোগদান করার পর নবীন কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে এসিআরে অতি উত্তম উল্লেখ করা হয়। এটি একটি স্বভাবজাত কাজ।
শরীফের বিরুদ্ধে ১৩ অভিযোগের বিষয়ে দুদক সচিব বলেন, তিনি কোনো অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব পেলে দুদকের নির্দেশিকা না মেনে নিজের খেয়ালখুশিমতো কার্যপরিচালনা করতেন। অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার সময় শরীফ উদ্দিন অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বহু লোককে নোটিশ ও টেলিফোনে ডেকে এনে হয়রানি করতেন।
অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা নো ডেবিট করার প্রয়োজন হলে কমিশনের সম্মতিতে আদালতের আদেশ নিয়ে ফ্রিজ করতে হয়। শরীফ উদ্দিন এ নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না। তিনি আদালতে অনুমোদন না নিয়ে ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেন।
কক্সবাজারে একজন সার্ভেয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে র্যাব ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করে। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা টাকা ২০২০ সালের ১০ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরীফকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে ১ বছর ৪ মাস ওই অর্থ নিজের হেফাজতে রাখেন। বিষয়টি হাইকোর্ট ডিভিশনের দৃষ্টিগোচরে এলে সুয়োমোটো রুল জারি করা হয়। এ বিষয়ে শরীফের ব্যাখ্যা আদালত গ্রহণ করেননি।
শরীফ উদ্দিন একটি মামলায় অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জবানবন্দি গ্রহণের জন্য তার দপ্তরে ডেকে অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রহার করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। বহু ব্যক্তি তার কাছে নিগৃহীত হয়েছেন।
দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে শরীফ উদ্দিনের কর্মকাল ৩ বছরের অধিক হওয়ায় অন্য আরও ২০ জন কর্মচারীর সঙ্গে তাকে বদলি করা হয়। এ বদলি আদেশ সবাই যথাসময়ে কার্যকর করেন। কিন্তু বদলির এ আদেশের বিরুদ্ধে শহিদুল ইসলাম লিটন নামের একজন মানবাধিকারকর্মীর ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট রিট খারিজ করে দেওয়া সত্ত্বেও বদলির আদেশ স্থগিত করা হয়েছে মর্মে অসত্য সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ধরনের কোনো আদেশ হাইকোর্ট দেননি।
সচিব বলেন, ২০২১ সালের ১৬ জুন শরীফকে চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) থেকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়। বদলির ১ মাস পর (১৭ জুলাই) তিনি ইমেইলে পটুয়াখালীতে যোগদানপত্র পাঠান। এরপর ১০ আগস্ট সশরীরে দুদকের পটুয়াখালী অফিসে উপস্থিত হন। বিলম্বে যোগদান করে তিনি কমিশনের আদেশ অবজ্ঞা করেছেন।