সর্দি-জ্বরে সারাদেশই যেন হাসপাতাল!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১২ পিএম, ৩০ জানুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:১৩ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
দেশে এক দিনে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাড়ছে নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ। এ পরিস্থিতিতে সারা দেশের অনেক ঘরই যেন জ্বর-সর্দিতে ‘হাসপাতালে’ পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়মিত করোনা আক্রান্তের যে সংখ্যা জানাচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। করোনা পরীক্ষায় মানুষের অনাগ্রহ এবং সংক্রমিতদের কোনো ব্যবস্থাপনায় না রাখাকে লাগামহীন সংক্রমণের কারণ হিসেবে দায়ী করছেন তারা। বহ্নি শিখা রায় (৩৫), রাজধানীর কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করেছেন দুই মাস আগে। চার দিন ধরে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। সঙ্গে কাশি থাকায় গলার স্বরও অনেকটা ভেঙে গেছে। শুধু নিজেই অসুস্থ নন, পরিবারের বাকি তিন সদস্যও পর্যায়ক্রমে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান। চার দিনেও করোনা পরীক্ষা না করার কারণ হিসেবে বহ্নি শিখা রায় বলেন, আমার পরিবার এটিকে সাধারণ সর্দি-জ্বর হিসেবেই নিয়েছে। যে কারণে সিরিয়ালসহ নানা জটিলতায় করোনা পরীক্ষায় যেতে চাচ্ছি না।
শুধু বহ্নি শিখার পরিবারই নয়, রাজধানীতে এমন আরও অনেক পরিবার আছে, যাদের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত। তাদের ঘর যেন একরকম ‘হাসপাতাল’ হয়ে পড়েছে। মফস্বল এলাকায় জ্বর-সর্দিতে আক্রান্তের সংখ্যাও কম নয়। উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে সিরিয়াল মেনে করোনা পরীক্ষা অনেকে ঝামেলা মনে করছেন। আবার অনেকে করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
হাসপাতালে রোগীর চাপ আছে, তবে ভর্তি কম : রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত হাসপাতাল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নতুন বছরের শুরু থেকেই এ হাসপাতালে জ্বর-সর্দিসহ করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী হাসপাতালে আসছেন। তাদের মধ্য থেকে কোভিড পরীক্ষায় অনেকেরই পজিটিভ আসছে। কিন্তু জটিলতা কম থাকায় হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নতুন, বাকিরা আগে থেকেই ভর্তি ছিলেন। তিনি বলেন, প্রতিদিনই আমাদের হাসপাতালের আউটডোর রোগীতে ঠাসা থাকে। সংখ্যায় যদি বলি, প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ রোগী আসেন সর্দি-জ্বর নিয়ে। তাদের অনেকেই করোনা পরীক্ষা করাতে চান না। যারা পরীক্ষা করান, তাদের মধ্যে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ জনের মতো করোনা পজিটিভ আসে। একজন রোগীর যদি শুধু সর্দি-জ্বর বা কাশি থাকে, তাহলে ভয় কম। আবার যদি তাদের কো-মরবিড কন্ডিশন না থাকে, তাহলেও ভয় কম। যদি মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, গলাব্যথা বা শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। অন্যথায়, বাসায় থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিতে হবে। সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় থাকলেও আইসোলেটেড থাকতে হবে। বাইরে একেবারে ঘোরাফেরা করা যাবে না। আশা করি, আক্রান্তরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো সমস্যা হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
লাগামহীন করোনা সংক্রমণ কমাতে ৩ করণীয় : দেশে সংক্রমণ বাড়ার কারণ হিসেবে জনগণের পরীক্ষায় অনাগ্রহ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, আমরা দেখছি হঠাৎ করেই দেশে শনাক্তের হার কীভাবে বেড়ে গেছে। শনাক্ত ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শঙ্কার বিষয় হলো অনেকে আক্রান্ত হলেও পরীক্ষা করাতে আসছেন না। তাদের করোনা পরীক্ষায় উৎসাহিত করা দরকার। এখন পরীক্ষা না করার কারণে পরবর্তী সময়ে তাদের করোনায় কোনো শারীরিক জটিলতা হলে তার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষত নিজের এবং পরিবারের সচেতনতার জন্য হলেও পরীক্ষা করা দরকার। সংক্রমণের লাগাম কীভাবে টেনে ধরা সম্ভব- জানতে চাইলে আইইডিসিআর উপদেষ্টা বলেন, আমরা সবসময়ই বলছি মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আসলে এসবে কোনো কাজ হচ্ছে না। আমরা দেখছি, সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে; কিন্তু সে অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে না। এ মুহূর্তে সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে করোনা পরীক্ষা জোরদার করতে হবে। সারাদেশে এখন বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়া যেখানেই মানুষ ভিড় করছে, সেখানেই সরকার চাইলে করোনা পরীক্ষার জন্য আহ্বান জানাতে পারে। আমরা দেখেছি যে, ডেল্টার সময়ে রাজশাহীর আম বাগানে, রাজশাহী শহরে সরকার বিশেষ প্রচারণা চালিয়েছে। এতে করে অনেকেই আগ্রহী হয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন। মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই অ্যান্টিজেন টেস্টের রিপোর্ট পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, জনসমাগমের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলোর কর্তৃপক্ষ যারা আছেন, তাদের কঠোর হতে বাধ্য করতে হবে। হোক তা বিপণিবিতান, কমিউনিটি সেন্টার, বইমেলা কিংবা বাণিজ্য মেলা। বিধিনিষেধে সবাই তাকিয়ে থাকে পুলিশ বা প্রশাসনের ওপর। সবাই ভাবে প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কিন্তু এটা তো আসলে পুলিশি সমস্যা না। পুলিশ হবে এখানে সহায়ক, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। মুশতাক হোসেনের ভাষায়, যাদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে হবে। এই যে হাজার হাজার লোকের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের যদি কোনো খোঁজ-খবর না রাখি, তাহলে তো তাদের কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়াবেই। দেশে পরীক্ষা কম হওয়ার ক্ষেত্রে এটিও একটি কারণ। তাদের যদি খোঁজ খবরই না রাখা হয়, তাহলে কেন একজন ব্যক্তি টাকা খরচ করে এসে পরীক্ষা করাবেন? কাজেই কারও করোনা শনাক্ত হওয়ার পর সরকারের উচিত তার ফলোআপ করা।
করোনা পরীক্ষা আরও সহজলভ্য করা উচিত : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, আমরা যদি বৈশ্বিকভাবে যেকোনো মহামারির চিত্র দেখি, তাহলে দেখব শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি থাকে। তারপর ধীরে ধীরে পরিমাণ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে নাই হয়ে যায়। যখনই মানুষের মধ্যে কোনো ভয় থাকে না, তখনই তারা কোভিড সংক্রান্ত আচরণবিধি অগ্রাহ্য করতে থাকে। সেই সুযোগেই সংক্রমণ বেড়ে যায়। বর্তমানে আমাদের সংক্রমণ এভাবেই বেড়েছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এ মুহূর্তে টিকাই মূল ভরসা। আমরা যদি দেখি, আগে যারা করোনায় মারা গেছেন তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, ক্যানসারসহ কো-মরবিডিটির রোগীই বেশি। পাশাপাশি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিকসহ সম্মুখসারির যোদ্ধারাও বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন। এ সময়ে কো-মরবিড কন্ডিশনসহ সম্মুখসারিতে যারা রয়েছেন, দ্রুত তাদের টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শামীম হায়দারের মতে, ওমিক্রনের স্ট্রেইন সম্পর্কে আমরা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নই। এটি মৃত্যুর কত বড় কারণ, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমরা দেখছি, ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার এখনও কম। রোগীরা ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমার কাছে মনে হয়, এক্ষেত্রে ঘরে বসে চিকিৎসা নেয়ার জন্য আলাদা গাইডলাইন তৈরি করা প্রয়োজন। করোনা আসার পর থেকে যত গাইডলাইন তৈরি হয়েছে, সবই হাসপাতালভিত্তিক। কিন্তু মানুষ ঘরে বসেও কীভাবে চিকিৎসা নিতে পারেন, সে সংক্রান্ত কোনো গাইডলাইন নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখছি যে, বর্তমানে করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো প্রতি ঘরে ঘরেই সর্দি-জ্বর, কিন্তু অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। করোনা সংক্রমণ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং সবার সঙ্গে মেলামেশা করছেন। ফলে সহজেই করোনা একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সংক্রমিত মানুষদের সরকারি উদ্যোগে একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। একইসঙ্গে করোনা পরীক্ষাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও সহজলভ্য করা উচিত।