আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু : নীল নকশার অংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০৮ পিএম, ২৩ জানুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
জন্মের মাত্র দুই বছর বয়সে জন্মদাত্রী মা বেগম খালেদা জিয়া ও সহোদর তারেক রহমানের সাথে ১৯৭১ সালের ২রা জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন আরাফাত রহমান কোকো, পরবর্তীতে বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বন্দী হিসেবে মুক্ত হন একই বছরের ১৬ ডিসেম্বরে। ১৯৮১ সালে একদল বিপদগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে তার জন্মদাতা পিতা মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১২বছর। পিতা হারোনোর শোক, স্মৃতি, পিতৃস্নেহ বঞ্চিত, মায়ের সংগ্রামী জীবনের সহচার্যে, সহোদরের স্নেহের ছায়াতলে কেটে যায় তার শৈশব ও কৈশোর।
রাজনৈতিক পারিবারিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠা লাজুক ছেলেটার ছিলো না কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অথবা কোন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত সময় পার করতে ভালবাসতেন তিনি। সেজন্য তাকে ২০০২-২০০৫ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য হিসেবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ক্রীড়াঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি সর্বমহলে সমাদৃত হন এবং পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ডেভেলপমেন্ট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান, ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ওল্ড ডিওএইচএস ক্লাবের চেয়ারম্যান এবং সিটি ক্লাবের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। মিরপুর ক্রিকেট একাডেমি, শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের রুপকার ছিলেন আরাফাত রহমান কোকো যা কিনা ক্রিকেটের আধুনিকায়নে এখন পর্যন্ত অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছে। ক্রিকেট উন্নয়নের শক্ত ভীত তার হাতেই নির্মিত হয়েছিলো যা আজ সর্বজন স্বীকৃত।
রাজনৈতিক অবিশ্বাসীদের হাত ধরে সেনা সমর্থিত মোড়কে বাকশালী কুশিলবদের সহযোগিতায় ২০০৭ সালের ১/১১'র সৃষ্টি হয় এবং তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন নীল নকশার অন্যতম ছিলো জিয়া পরিবার তথা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করা। সেটির বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের নিজ বাসভবন থেকে আবারও মায়ের সাথে রাজনৈতিক কারণে বিনা দোষে গ্রেফতার ও বন্দী হন সেই রাজনীতি বিমুখ, অরাজনৈতিক ক্রীড়াপ্রেমী, ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ বন্দী আরাফাত রহমান কোকো।
শৈশবের মতো যুবক বয়সেও বন্দী হন গণতন্ত্র হত্যায় মাতাল দিশেহারা জালিমের হাতে, শৈশবের বন্দী ছিলো ভিনদেশীদের হাতে আর যৌবনে বন্দী হন নিজ দেশীয় ভিনদেশী সহচরদের হাতে। শুরু হতে থাকে নীল নকশা বাস্তবায়নের নির্মম ও নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। টি এফ আই সেলে বন্দী রেখে চলে অমানসিক এবং অবর্ননীয় নির্যাতন। গ্রেফতারের সময় সুঠাম দেহের অধিকারী যুবককে পরবর্তীতে আমরা দেখেছি বুকে হাত দিয়ে কুকড়িয়ে হাটতে।
সেনাসমর্থিত ১/১১ সরকারের মূল এজেন্ডা ছিলো বেগম খালেদা জিয়াকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করা এবং জাতীয়তাবাদী দলের আগামীর সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিঃশেষ করে দেওয়া, যার কারণেই আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। শান্তিপ্রিয়, নিরাপরাধ, অরাজনৈতিক, ক্রীড়ামোদী, সমাজ সেবককে ৭টি রাজনৈতিক হয়রানি মামলা দেওয়া হয় এবং সে সকল হয়রানি মূলক মামলায় বার বার রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার, জেলে প্রেরণ, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিলেন আরাফাত রহমান কোকোকে। দীর্ঘ প্রায় ১১মাসের এক বিভিষীকাময় পরিবেশ থেকে অসুস্থ শরীরে সুচিকিৎসার প্রয়োজনে শর্তযুক্ত মুক্তি লাভ করেন তিনি। এই সুদীর্ঘ ১১ মাসে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত করে ফেলেন আরাফাত রহমান কোকোকে। প্যারোলে মুক্তির মাধ্যমে শুরু হয় অনিশ্চিত নির্বাসিত জীবন।
২০০৮ সালের ১৮ জুলাই থ্যাইল্যান্ডের ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। শুরু হয় শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত'র চিকিৎসা, কিন্তু মানসিক চিকিৎসা রয়ে যায় অধরা। মা বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ দিনের সঙ্গীর মানসিক চিকিৎসা ছিলো সম্ভবত মায়ের সান্নিধ্য, আপন সহোদরের স্নেহ, পারিবারিক আবহ, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সহচার্য। সেটাতো সম্ভবপর হয়নি, অপরদিকে প্রিয় মায়ের বন্দীত্ব, মায়ের শারীরিক অসুস্থতা, অসুস্থ ভাইয়ের নির্বাসিত জীবন এবং ফেলে আসা স্বদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তার মানসিক স্বাস্থ্য আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
মায়ের সাথে ২০১২ সালে সশরীরে দেখা হয়েছিলো সিঙ্গাপুরে যেটা কিনা মায়ের সাথে ছিলো শেষ দেখা কিন্তু আপন সহোদরের সাথে গ্রেফতারের পরে সশরীরে দেখা হয়েছিলো কিনা সেটা নিশ্চিত ভাবে জানা নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে থাকে মানসিক অশান্তি এবং চিন্তা থেকেই উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ক্ষনজন্মা এই নিরাপরাধ ক্রীড়ামোদী সমাজসেবক সেই নির্যাতনের মানসিক ও শারীরিক ক্ষত বয়ে বেড়াতে বেড়াতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি নির্বাসিত ও আইনের চোখে পালাতক আসামি হয়ে আপন জনকে কাছে না পাওয়ার এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইহকাল ত্যাগ করেন কোকো। এককথায় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব জনিত রোগে মৃত্যু বরণ করেন আরাফাত রহমান কোকো। তার মৃত্যু দেশবিরোধীদের পরিকল্পনার চূড়ান্ত পরিনতি।
লেখক : গালিব ইমতেয়াজ নাহিদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।