ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার টানাপোড়েন কেন : বিবিসি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:৫৯ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন প্রশাসনের কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে। এ বছর গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার দিবসে বিশেষ বাহিনী র্যাব ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সঙ্গে লেখক অভিজিৎ রায়ের পলাতক খুনিদের তথ্যের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে দেশটি। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা এবং বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন কেন সোচ্চার সেটি নিয়েও আছে কৌতূহল। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের একপ্রকার টানাপোড়েন হিসেবেই দেখছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, ‘সম্পর্কটা একটা জটিল রূপ ধারণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র একটা পরাশক্তি, তারা যদি একটা শব্দ ব্যবহার করে যে আমরা কনসার্ন তখনই কিন্তু একটা মেসেজ দেয়, যে আমরা তোমাদের কাজ পছন্দ করছি না।’ ‘তো যখন কনসার্ন জানালেই যেখানে সরকার নড়েচড়ে বসে, সেখানে এতকিছু করছে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে নাখোশ তারই প্রকাশ পাচ্ছে।’ মিজ কিবরিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ‘বাইডেন প্রশাসন এসে কিন্তু তাদের নীতির আপাতদৃষ্টিতে আমরা বলতে পারি একটা পরিবর্তন করছে। পরিবর্তনটা কীভাবে যে তারা গণতন্ত্রকে সংগঠিত করবে। এখানে আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু ব্যাপারে তারা অখুশি এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
সম্পর্কে অবনতি নাকি মার্কিন নীতির পরিবর্তন?
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হিসেবে দেখা না হলেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বাইডেন প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে ঠাঁই দিয়েছে। তবে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এ নীতির কৌশলগত ব্যবহার হচ্ছে। ‘মানবাধিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়টি বাইডেন প্রশাসন বলছে তারা গুরুত্ব দেবে এবং দিতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কিছু কৌশলেরও বিষয় আছে। কৌশল হচ্ছে তার জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ।’ ‘দুটো জিনিসকে তারা প্রধান বা কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করছেন। তার একটা হচ্ছে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের প্রশ্ন। দ্বিতীয় যেটা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসন গোড়া থেকেই এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নজর দিয়েছে।’ ড. রীয়াজ বলেন, ‘সেক্ষেত্রে তারা চীনকে তারা মনে করছেন তাদের বড় রকম প্রতিদ্বন্দ্বী এবং চীনের যে প্রভাব বলয় বিস্তার হচ্ছে সেটা তারা রোধ করতে চাচ্ছে। সে জন্য তারা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ বলতে পারেন সেটা তৈরি করছে।’ তার মতে, ‘বাংলাদেশে চীনের এক ধরনের প্রভাব বিস্তার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে এটিকে বিবেচনার মধ্যে নিয়েছে। তারা দেখতে পাচ্ছে যে, বিভিন্নভাবে তাদের যে মূল জায়গাগুলো পররাষ্ট্রনীতির তার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানটা ব্যত্যয় বলেন এক ধরনের সংঘাত বলেন সেটা দেখা যাচ্ছে।’ ‘যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছে তা নয়। অন্ততপক্ষে আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে স্পষ্টভাবেই যে, বাংলাদেশ কিছু কিছু জায়গায় যেটা নাকি আমরা বলবো কোর্স কারেকশন দরকার। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ তার সঙ্গে কাজ করুক।’
চীনকে ঠেকানো মূল লক্ষ্য?
বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যান্ড কর্পোরেশনের সেন্টার ফর এশিয়া প্যাসিফিক পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিক দোসানি। ‘উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং নিকটেই সিটওয়ে বন্দর এগুলো চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে দীর্ঘমেয়াদে এসব জায়গায় চীনের পরিবর্তে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হোক। এটা সত্যিই একটা দীর্ঘমেয়াদি খেলা।’ মি. দোসানি মনে করেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন তার মূল লক্ষ্য চীনকে ঠেকানো। এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনে পররাষ্ট্রনীতির স্টাইলে পরিবর্তন দেখছেন তিনি। ‘বাংলাদেশ সম্ভবত দুই শক্তির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ এই জায়গায় এসে আটকে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘এটা কেবল বাংলাদেশের একারই সংকট নয় পুরো এশিয়া এই সমস্যা ফেইস করছে। যুক্তরাষ্ট্র এই মূহূর্তে তাগাদা অনুভব করছে এবং তাদের এখনকার স্টাইল হচ্ছে হয় তুমি আমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে। আমি মনে করি এটাই ঘটছে।’
ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না আমেরিকা?
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। এদেশে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ সময় এ নিয়ে নীরব ছিল। এ অঞ্চলে মার্কিন মিত্র ভারতের সমর্থনও পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখার মার্কিন নীতির একটা পরিবর্তন হিসেবেও দেখছেন আলী রীয়াজ। ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে এখন ভারতকেন্দ্রিক বা নয়াদিল্লিকেন্দ্রিক যে চিন্তা-ভাবনা ছিল, তার থেকে বেরিয়ে আসার একটা ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে সেটা কিন্তু নয়।’ ড. রীয়াজ বলছেন, ‘আমার ধারণা ভারত এবং পাকিস্তানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ায় যেসব দেশ আছে, শ্রীলংকা বলুন, মালদ্বীপ বলুন, নেপাল বলুন- এগুলোর ব্যাপারে আসলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নতুন করে ভাবার একটা ইঙ্গিত আমি দেখতে পাচ্ছি।’ এ ব্যাপারে রফিক দোসানি বলেন, ‘আমি মনে করি, এই প্রবণতা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র ভারত-নির্ভরতা কমাতে চায়। এবং এটাও চায় যে ভারতের চোখে এ অঞ্চলকে না দেখা হোক।’ তার মতে, ‘এখানে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে যেভাবে মোকাবিলা করছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হতাশার প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে।’ সূত্র : বিবিসি