নিত্যপণ্যের বাজার উচ্চমূল্যে অস্থির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:১৪ পিএম, ২৯ জুন,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:৩৬ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ঢাকার একটি কলেজে ডিগ্রিতে পড়ছেন নিতু ইসলাম। পাশাপাশি একটি হাসপাতালের অভ্যর্থনা ডেস্কে খণ্ডকালীন চাকরি করছেন। মাকে নিয়ে পুরান ঢাকার একটি বাসায় সাবলেট থাকেন। গতকাল শুক্রবার রায়সাহেব বাজারে নিতুকে দেখা গেল দোকানে দোকানে ঘুরে পেঁয়াজের দরকষাকষি করতে। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ঢাকায় সবকিছুর দাম বেশি, শুধু মানুষের দাম কম! উচ্চমূল্যের কারণে বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে বেশিরভাগ মানুষের দশা নিতুর মতোই।
নিতু কালবেলাকে বলেন, ‘পড়াশোনার খরচ, বাসা ভাড়া, খাওয়াদাওয়ার খরচ সব মিলিয়ে আসলে চলা যাচ্ছে না এ বাজারে। পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একশ টাকার নিচে পেঁয়াজ মিলছে না। দাম বেশির কারণে হাফ কেজি কিনলাম।’ তিনি বলেন, চালের দামও বেড়েছে। ঈদের আগে নাজিরশাইল কিনতাম ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি। এখন তা ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন এভাবে চড়তে থাকলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের বাঁচা কষ্ট হয়ে যাবে।
কোরবানির ঈদের আগে থেকেই চড়া নিত্যপণ্যের বাজার। ঈদ পার হয়ে গেলেও ভোক্তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই। এক মাস ধরে উচ্চমূল্যে অস্থির হয়ে আছে নিত্যপণ্যের বাজার। কোনোভাবেই কমছে না দাম। সাত দিনের ব্যবধানে আবারও বেড়েছে বেশকিছু পণ্যের দাম। এতে চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সরবরাহে খুব একটা ঘাটতি না থাকলেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম বাড়তি।
সম্প্রতি বেড়েছে চাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদের দাম। জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি দেশি বাসমতি, মিনিকেট, মোটা চালে বেড়েছে ২ থেকে ৫ টাকা। বর্তমানে বাসমতি ৯০ টাকা, মিনিকেট ৭০, মোটা স্বর্ণা ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি আদার কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। এ ছাড়া এখনো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে ডিম। প্রতি ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমলেও বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজি। এসব পণ্য কিনতে ক্রেতার বাড়তি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নয়াবাজার, রায়সাহেব বাজার, নিউমার্কেট কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। এদিকে বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি দেখা যায়নি। বিক্রেতারাও ক্রেতার চাহিদামতো বিক্রি করছেন। কিন্তু দাম বেশি। ক্রেতারাও মসলাজাতীয় পণ্য কিনতে এসে বাড়তি দামের কারণে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা বলছেন, বাজারে পণ্য থাকার পরও বিক্রেতারা কোরবানির আগে থেকেই বাড়তি দামে সব ধরনের মসলা পণ্য বিক্রি করছেন। প্রতি সপ্তাহে একটু একটু করে দাম বাড়াচ্ছেন। বাজারে বর্তমানে এক পণ্যের দাম কমলে, আরেকটির বাড়ছে। ফলে বাজার করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কপালে হাত। বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়; আলু ৬৫ টাকা। এ ছাড়া কাঁচামরিচের কেজি ২৬০ থেকে ৩০০ টাকা।
নয়াবাজারের চাল বিক্রেতা মেসার্স কামাল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কামাল বলেন, চালের বাজার এক-দেড় মাস ধরে স্থিতিশীল ছিল। কারণ এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে সরবরাহও ভালো ছিল। ঈদের পর হঠাৎ চালের দাম বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন কিছু মিল মালিক। এতে বাজারে চালের সরবরাহ কিছুটা স্থবির। সবচেয়ে বড় কথা, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি থামানো যাচ্ছে না। যদি রাস্তায় চাল বহনকারী ট্রাকগুলো কোথাও কোনো চাঁদা না দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারত, তাহলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব হতো।
সবজির বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁপে ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০, কচুরমুখী ৮০, কাঁকরোল ৬০, করলা ১০০, ধুন্দল ৬০, বরবটি ৮০, ঢ্যাঁড়শ ৫০, বেগুন ১০০, পটোল ৫০, ঝিঙ্গা ৬০, কচুর লতি ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া জালি প্রতি পিস ৪০ ও লাউ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কলার হালি ৫০ টাকা।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের ক্রেতা নাজিমুদ্দিন খান বলেন, দেশে উৎপাদিত পণ্যও আমাদের বিদেশি পণ্যের দামে কিনতে হয়। এক কেজি পেঁপে কিনলাম ৫০ টাকা দিয়ে। এক বছর আগে ২০ টাকায় কিনেছি। শুধু সবজির দাম নয়, প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে দ্বিগুণ। কোনো কোনো পণ্যের তো ৫-৬ গুণ দাম বেড়েছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। সরকার যদি তাদের বাজার তদারকি ব্যবস্থা পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে নিয়মিত করত, তাহলে কিছুটা হলেও বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকত।
বাজারে গরুর মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা। খাসির মাংসের কেজি ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ছাগলের মাংস ১ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। দেশি মুরগি ৭০০ থেকে ৭৩০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৯০ টাকা ও লাল লেয়ার ৩৫০ টাকায় এবং প্রতি কেজি সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। মাছের মধ্যে বড় চিংড়ির কেজি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, পাঙাশ ১৮০, তেলাপিয়া ২২০, কার্প মাছ ২৬০ টাকা, রুই ৩৫০ টাকা, মলা ২৮০ ও কৈ ২০০ টাকা কেজি। পাবদার কেজি ৪৬০ টাকা। ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম আকারের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি একটি ডিমের দাম ২০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু সরকার যখন ডিম আমদানির কথা ঘোষণা দিল এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে মাঠে কাজ করল, তখন ২০ টাকার ডিম ১০ টাকায় নেমে আসে।
তিনি বলেন, সরকার যদি চায় নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় ও কমানো সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মুখে বলা কথা মাঠে কার্যকর করতে পারলে এ অসহনীয় নিত্যপণ্যের দাম ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট থেকে আমরা সাধারণ মানুষ রক্ষা পাব।