বাজারে টাকার সরবরাহে ফের লাগাম টানা হচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:০৬ এএম, ১৯ মে,রবিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৭:৪৩ এএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাজারে টাকার সরবরাহ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা ব্যাংকের বাইরে চলে এসেছে। এই টাকা এখন বাজার অর্থনীতিতে ব্যাপক মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করছে। মুদ্রাস্ফীতি হলো দেশের এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে সীমিত পণ্য ও সেবা প্রাপ্তির পেছনে মানুষকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। ফলে দেশ ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট করার পাশাপাশি সাধারণের দুর্ভোগ বাড়ায় ও জনজীবন বিষিয়ে তোলে।
এই বাস্তবতায় আসন্ন বাজেটে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চলেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। এজন্য বাজেটীয় উদ্যোগে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ব্যয় বৃদ্ধির বাইরে সরাসরি পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংকের বাইরে টাকার সরবরাহে যতটা সম্ভব লাগাম টানা হবে। বাজেট-পরবর্তী জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে ঘোষিতব্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে এই লক্ষ্যের বাস্তবায়ন ঘটানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপ বাজার অর্থনীতিতে একদিকে টাকার অবাধ প্রবাহের রাশ টেনে ধরবে, অন্যদিকে ইতোমধ্যে বাজারে সৃষ্ট ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দমনেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর মার্চে (২০২৩) দেশে ব্রড মানির (এম-২) পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। চলতি বছর মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৪১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। তার আগে ২০২২ সালের মার্চে দেশে ব্রড মানির (এম-২) পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এর মানে হলো ব্যাংকের বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের বড় অংশ মেয়াদোত্তীর্ণের পর উত্তোলনের মাধ্যমে বাজারে চলে এসেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটেও ব্যাংকের বাইরে টাকা যাওয়ার অবাধ প্রবাহে রাশ টেনে ধরার পদক্ষেপ রয়েছে। যার আওতায় এরই মধ্যে বাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তুলে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ টানা হয়েছে বিভিন্ন সময় বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে। কিন্তু একই সময়ের ব্যবধানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা ব্যাংকের বাইরে চলে এসেছে। এই বাস্তবতায় সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরও এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ডলার বিক্রির হার সামান্য কমিয়ে বিল-বন্ড বিক্রির হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রাখা হচ্ছে।
বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে চায়, সময়ের চাহিদা বিবেচনায় সেগুলো সঠিকই আছে। তবে আমি মনে করি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থির রাখার চেষ্টা আরও বেশি জরুরি। যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। এজন্য রিজার্ভ বাড়ানোর ওপরই বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও দূর করতে হবে। বিশেষ করে কেন মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে, তার কারণ আগে জানতে হবে। তার ওপর ভিত্তি করে করণীয় ঠিক করতে হবে। বাজার ব্যবস্থা ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে এ কৌশলগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে প্রায় দেড় বছর ধরে লাগাতার ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিতে আক্রান্ত দেশ। খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যই বলছে, গত এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যখন বাস্তবতা, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ডলারের দাম এখন এক লাফে ৭ টাকা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ঋণের সুদহারও। বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা কেটে যাওয়ার জোরালো আভাস না থাকায় দেশে ক্রমবর্ধমান ডলারের দর ও সুদের হার সামনে আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ আগামী অর্থবছরও বজায় থাকবে বলে মনে করছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এজন্য আগামী অর্থবছর ঘোষিত মুদ্রানীতির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। একইভাবে ঋণের সুদ ও ডলারের দর বাজারভিত্তিক হওয়ায় ব্যাংকের আমানতের সুদহারও বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকে গ্রাহকের যেসব মেয়াদি আমানতের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই আমানত পুনরায় বিনিয়োগে মুদ্রানীতির মাধ্যমে উৎসাহ জোগানো হবে। সেখানে সুদহারের বাইরে আগামী এক থেকে তিন বছর ওই অর্থ পুনরায় বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা রাখার বিষয়টি জোরালো ভাবনায় রয়েছে।
একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য কৌশলের অংশ হিসেবে পণ্যের আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি রুখবে সরকার। এটাও করা হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয় করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ব্যাংক কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের অশুভ আঁতাত করতে দেওয়া হবে না। ফলে ওভার ইনভয়েসিং করার বা চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখানোর সুযোগ থাকবে না। এ প্রক্রিয়ায় অসাধু আমদানিকারকদের বিদেশে অর্থ পাচারের সুযোগও কমে আসবে।
বাজারে পণ্য সেবার সরবরাহ বৃদ্ধি করবে সরকার। এজন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি বা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের সময়সীমা বর্তমান সময়ের তুলনায় আরও কমিয়ে আনা হবে, যাতে আমদানিকারকরা মজুতের সময় না পায় এবং আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্য দ্রুত বাজারে চলে যায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বাজারে ছাড়ার সুযোগও কমে আসবে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এজন্য সরকার বাজেটারি পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষি খাতে সার, বীজ, সেচ ও যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ নীতিমালার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণও বাড়ানো হবে। প্রকৃত কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছানো নিশ্চিত করা হবে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষার আওতাও বৃদ্ধি করা হবে। বিশেষ করে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ) আওতা এবং ভর্তুকি মূল্যের কার্যক্রমে বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানো হবে। একই উদ্দেশ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশনকে এসব ক্ষেত্রে করণীয় সব ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।