ভ্যাটের বোঝা বাড়ছে আইএমএফের চাপে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ১৩ মে,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৩:৫৮ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছর থেকে সব রকম পণ্য ও সেবায় অভিন্ন হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নির্ধারণ করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভ্যাটের হার হবে ১৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে এ ঘোষণা দেওয়া হলেও সিদ্ধান্তটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের চিন্তা করা হচ্ছে। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মানতে গিয়েই এনবিআরকে এমন পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। গতকাল রোববার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআর কর্তাদের বৈঠকে এ বিষয়ে সম্মতি পাওয়া গেছে। আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভেদে ৩, ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে সব পণ্য ও সেবায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আইএমএফের শর্ত পূরণের চাপ রয়েছে। এ কারণে আগামী বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কে অব্যাহতি তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এনবিআর। তারই অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছর থেকে ভ্যাটের অভিন্ন হার বাস্তবায়নের চিন্তা করছে সংস্থাটি। প্রাথমিকভাবে সব খাতে না করলেও ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি খাতের ক্ষেত্রে অভিন্ন ভ্যাট হার হবে ১৫ শতাংশ। বর্তমানে যেসব খাতে ৩ শতাংশ বা ৫ শতাংশ রয়েছে, সেখানে আগামী বাজেটেই এই হার বাড়তে পারে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বর্তমানে যেসব খাতে ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ কার্যকর রয়েছে, সেখানে আগামী অর্থবছরে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া বেশকিছু খাতের ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ভ্যাটের অভিন্ন হারের মতো অব্যাহতিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিচ্ছে এনবিআর।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া এনবিআরের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার ভ্যাটের আদর্শ হার ১৫ শতাংশ কার্যকর করার দিকে এগোচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। ধাপে ধাপে প্রতিটি খাতে ভ্যাটের অভিন্ন হার বাস্তবায়ন করা হবে।’
এ বিষয়ে মতামত চাওয়া হলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ কালবেলাকে বলেন, ‘২০১২ সালের ভ্যাট আইনে সব খাতে ১৫ শতাংশ করার কথা ছিল। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে এসে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সব পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন হার করা হয়েছে। আগামী বাজেট থেকে অভিন্ন হার কার্যকর করার সিদ্ধান্ত তারাই নেবে, যারা আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়ন করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আসলে পুরো বিষয়টি এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাটের অভিন্ন হার থেকে সরে এসেছিল সরকার। এবার আইএমএফের পরামর্শে আবার সেদিকে এগোচ্ছে।’
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ভ্যাট আদায় বাড়ানো এবং ভ্যাটের লিকেজ বন্ধ করার জন্য অভিন্ন হারে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ১৫ শতাংশ হার হলে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়বে, তবে এই সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
তবে অভিন্ন ভ্যাট কার্যকর করা হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম। এনবিআরের উদ্যোগ সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ভ্যাটের বিভিন্ন হার রয়েছে। যেমন রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ শতাংশ, কিছু ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ। সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করা হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে খরচ বেড়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী ইতিবাচক মত দিয়েছেন। সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হলে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হতে পারে। যদিও সাধারণ আমদানিকারকরা গাড়ি আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির সুবিধা দেওয়া পুরোপুরি অযৌক্তিক। শূন্য শুল্ক সুবিধা বাতিল করে ২৫ শতাংশ করা হলেও এটা শুল্ক সুবিধার মধ্যে পড়ে। এমপিদের কেন এই ধরনের সুবিধা দিতে হবে। এটা কর বৈষম্য।
জানা গেছে, আয়করের ক্ষেত্রে বেশকিছু অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। এ ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের অবকাশ সুবিধার মেয়াদ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে এ খাতে কর অব্যাহতি সুবিধাপ্রাপ্ত ২৭টি পণ্যের মধ্যে কিছু পণ্যের কর অবকাশ সুবিধা তুলে নেওয়ার ঘোষণা আসতে পারে। আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে। আর শর্তসাপেক্ষে করপোরেট করহার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে কর কর্মকর্তাদের কর ফাইল অ্যাসেসমেন্টের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে করদাতা নিজেই রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। অডিট করতে পারবেন আয়কর কর্মকর্তারা।
আয়কর খাতে কর্মকর্তাদের অ্যাসেসমেন্ট ক্ষমতা বাতিলের উদ্যোগকে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বনির্ধারণী পদ্ধতি হলে কোনো করদাতাকে কর কর্মকর্তাদের কাছে যেতে হবে না। এ ক্ষেত্রে ভোগান্তি কমবে। এটা যদি সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়, তাহলে ভালো হবে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, শুল্ক বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বেশকিছু বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে সম্পূরক শুল্ক হার ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেওয়া শুল্ক অব্যাহতি কমিয়ে আনার প্রস্তাবেও সায় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের বৈঠকটি আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান এবং এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, তিনটি ধাপে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। বাজেট নিয়ে আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবে এনবিআর। সেখানে অর্থমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। ওই বৈঠকেই আগামী বাজেটের কর সংক্রান্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।