আমানত তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা, তারল্য সংকটে ব্যাংক খাত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৫৪ এএম, ৮ মে,
বুধবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:০৪ এএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
উচ্চ সুদহারেও ব্যাংকে টাকা রাখছে না মানুষ। আশঙ্কাজনক হারে পৌঁছেছে আমানত উত্তোলনের প্রবণতা। তীব্র হচ্ছে আস্থার সংকট। ফলে তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে ব্যাংক খাত। ধার করে চলছে বেশিরভাগ ব্যাংক। অন্যদিকে অর্থের জোগান কম হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে বিনিয়োগ। দীর্ঘমেয়াদে মূলধন সংকটে পড়তে পারে অনেক ব্যাংক।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সুদহার ৪ শতাংশ বাড়িয়েও পর্যাপ্ত আমানত সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। বিশেষ করে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থা সংকটাপন্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবাস্তব নীতি ও অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-জালিয়াতির খবর বেরিয়ে এলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো বিভিন্ন নীতি সহায়তা দিয়ে জালিয়াত চক্রকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষ কয়েক দফায় ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন করেছেন।
সম্প্রতি ব্যাংক একীভূতকরণের পদক্ষেপের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি বলে দেয় ওই ব্যাংকটি দুর্বল; তাহলে কোন বিশ্বাসে সেই ব্যাংকে গ্রাহক টাকা রাখবে। আর সব গ্রাহক যদি একসঙ্গে টাকা উত্তোলন শুরু করে তাহলে কারো পক্ষেই তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।’
অপরদিকে তথ্য লুকোচুরি, ভুল তথ্য কিংবা নিজেদের তৈরি প্রতিবেদন অস্বীকার করার মতো কাণ্ড ঘটিয়ে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির তৈরি করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য পরবর্তী সময়ে ভুল প্রমাণিত হওয়ায় অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৬ শতাংশ; তবে ব্যাংকটি এক্সিমের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৭০ শতাংশের বেশি ঋণই খেলাপি এমন তথ্য বেরিয়ে আসছে।
অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র নয়। অন্যদিকে বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে এ অংক সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া মূলধন ঘাটতিতে থাকার পরও অনেক ব্যাংককে ডেফারেল সুবিধার নামে বিশেষ ব্যবস্থায় লাভ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব এক প্রতিবেদনে দেশের অধিকাংশ ব্যাংককে লাল ও হলুদ তালিকাভুক্ত করা হয়। গণমাধ্যমে এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর নিজেদের প্রতিবেদনকেই অস্বীকার করে বসেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র। এতে ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যদি এই তালিকা ভুল হয়; তাহলে ভালো ব্যাংকের ক্ষতি করা হলো কেন? আর যদি তালিকাটি সঠিক হয়; তাহলে মুখপাত্র তা অস্বীকার করলেন কেন? এর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকটিকে লাল তালিকাভুক্ত করার খবর বেরিয়ে আসার পর অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা আমানত উত্তোলন হয়েছে। এ কর্মকর্তার প্রশ্ন, কোন বিবেচনায় কিছু ব্যাংককে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, যা এখন অস্বীকার করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক?
চাপে দুর্বল ব্যাংক
গত মাসে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনার মধ্যেই বেসিক ব্যাংক সরকারি নয় এমন ব্ক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র। এতে বেসিক ব্যাংক থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা আমানত উত্তোলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে ব্যাংকটি দাবি করেছে ‘বেসিক ব্যাংক শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক’- এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এছাড়া ব্যাংকটির পর্ষদ বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে বর্তমানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
মূল্যস্ফীতিকে প্রাধান্য দিয়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে আমানত ও বিনিয়োগের সুদহারও। সুদ বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকে আমানত বাড়ার কথা। অপরদিকে ঋণে সুদ বেশি হওয়ায় বিনিয়োগ কমে গিয়ে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য জমা হওয়ার ফলে তা বেশি সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাবে। ফলে সার্বিকভাবে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ব্যাংকগুলোতে টাকার সংকট থাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাছাড়া ব্যাংকের আমানতও বাড়েনি, মূল্যস্ফীতিও কমেনি।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দেশের আর্থিক খাতের সংকট কাটাতে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংক ঋণের সুদে ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার বৃদ্ধিতে এ সময় সব ব্যাংক আমানতেও সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে মানুষের হাতে থাকা টাকা ব্যাংকে যেতে শুরু করে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর প্রথম ধাপ হিসেবে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পদ্ধতিতে আগামী বছরের মার্চে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত হওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা আসে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের গ্রাহকরা আতঙ্কে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে চলা অনিয়মের কারণে সৃষ্ট আস্থাহীনতায় ব্যাংক থেকে অর্থ বেরিয়েছে, সেগুলো ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। একটি শ্রেণি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোও তারল্য ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্যের (নগদ টাকা) পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষে ওই ব্যাংকগুলোর নগদ কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের ৮ মাসে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নগদ কমেছে ৭ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। একই অবস্থা রাষ্ট্রের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও। অর্থবছরের শুরুতে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকা ছিল ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর তারল্য কমেছে ২৩৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাইয়ে পুরো ব্যাংক খাতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ সার্বিক ব্যাংক খাতে তারল্য কিছুটা বেড়েছে, তবে সরকারি ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মার্চ ও এপ্রিলে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে আমানত আরও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীন আহমেদ বলেন, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে কাজ করতে হবে। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে টাকা পাওয়া যাবে না এমন ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক বন্ধ হচ্ছে কিন্তু গ্রাহকের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হয় না। সুদ হয়তো পাওয়া যায় না। কিন্তু মূল টাকা পেতে সমস্যা নেই। এজন্য আমানতের বীমা এক লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা করা দরকার। তাহলে আমানতকারীরা ভরসা পাবে। যেকোনো মূল্যে ব্যাংকে আমানত বাড়াতে হবে। এজন্য ৩ থেকে ৬ মাস মেয়াদি আমানতের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
তবে ব্যাংকাররা বলছেন, হিসাব করলে দেখা যায় গত আট মাসে মোট তারল্য বাড়ার যে চিত্র তা হতাশাজনক। কারণ আমানতের সুদ হিসাব করলেও এর চেয়ে বেশি অর্থ থাকার কথা। এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো নয়। তবে সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এটি হয়তো সমান সমান আছে, কিন্তু সার্বিকভাবে বাড়েনি।
মূলত, ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর আস্থাহীনতায় আমানত উত্তোলনের হার বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সম্প্রতি বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তোলার আবেদন করেছেন। এরই মধ্যে বেসিক ব্যাংক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত হারিয়েছে। বিডিবিএল থেকেও দেড়শ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে গ্রাহকরা। একীভূতের তালিকায় থাকা অন্যান্য ব্যাংকের পরিস্থিতিও প্রায় একই। তারাও আমানত হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। খারাপ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার খবরে ভালো ব্যাংকের গ্রাহকরাও আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলছেন।