মূল্যস্ফীতির দ্বিমুখী চাপে ঈদবাজার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:২৩ এএম, ২৫ মার্চ,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:২৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
নতুন পোশাকে ঈদের খুশি ভাগাভাগির রেওয়াজ দীর্ঘকালের। বাংলাদেশে এটি পরিণত হয়েছে সামাজিক ঐতিহ্যে। ফলে প্রতি বছর পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মনস্তুষ্টি ও সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা কমবেশি সব পরিবারেই থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে নতুন পোশাক কেনার তাগিদও ঘরে ঘরে ততই জোরালো হচ্ছে। বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতানে চোখ রাখলেই সেটি টের পাওয়া যায়।
ঈদ এলে জামা-জুতা, খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটার বাড়তি চাপ থাকাটা খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। নানা কারণে সময়টি খুব প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে এবার সামাজিকতা রক্ষার জন্য ঈদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা যেন রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কারণ অন্যান্য ঈদে পোশাকসামগ্রীর দাম কিছুটা চড়া থাকলেও জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এবার একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, অন্যদিকে পোশাকসহ ঈদ সংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে এ বছর ঈদবাজার পড়েছে মূল্যস্ফীতির দ্বিমুখী চাপে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের দামের অস্থিরতা, পণ্যভিত্তিক কারসাজি, সিন্ডিকেট রুখতে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের অভাব এবং আইনের শাসনের দুর্বলতাসহ নানা কারণে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। যার প্রভাবে জীবনধারণে ব্যবহার্য সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে মানুষের আয় না বেড়ে উল্টো অনেক ক্ষেত্রে সংকুচিত হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে মানুষের হিমশিম দশা। এ অবস্থায় অনেকের কাছেই সামাজিকতা রক্ষার নামে ঈদ কেনাকাটার চাপ নিঃসন্দেহে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘ঈদে সবাই আনন্দ করতে চায়। তবে এবার মানুষকে একটু বুঝেশুনেই আনন্দ উদযাপন করতে হবে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে ক্রেতা-ভোক্তা তথা দেশ। তদুপরি আয় বৈষম্যও মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি আয় মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। এদের কেনাকাটাতে কোনো বাধা নেই। কারণ, এই অধিক আয়ের মানুষ তাদের ১০ শতাংশ ব্যয় কম করলেও সেটি মূল্যস্ফীতিতে খুব বড় প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু কম আয়ের ৯০ শতাংশ মানুষ যদি সামাজিকতা রক্ষার নামে একযোগে কেনাকাটায় যোগ দেয়, তাহলে সেটি হবে আগুনে ঘি ঢালার সমান, যা আগামীর মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।’
তিনি মনে করেন, আমরা চাইলেই একটু সংযত হতে পারি। এতে নিজেরাও ভালো থাকব। অর্থনীতির জন্যও ভালো হবে। মূল্যস্ফীতির চাপও কিছুটা সহনীয় থাকবে। কিন্তু ভোক্তা হিসেবে যদি আমরা এর উল্টোটা করি অর্থাৎ যা আছে তার থেকেও বেশি কেনাকাটা করি—এতে অর্থনীতি সাময়িক চাঙ্গা হবে বটে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘স্বল্প সংখ্যক মানুষের আয় বাড়লেও অধিকাংশ মানুষের আয় না বাড়ার কারণে দেশে যে বিরাট আয় বৈষম্য তৈরি হয়েছে, ঈদ উৎসব ঘিরে কেনাকাটায় সামাজিকতা রক্ষার যে টানাপোড়েন তারই বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই ঈদ সামনে রেখে প্রিয় সন্তানের হাতেও একটি সুন্দর পোশাক তুলে দিতে পারছে না অনেকে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে সব মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কার্যকর পদক্ষেপও নিতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত প্রতিবছর ঈদে পোশাকে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন ঘটে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। তবে এবার সরেজমিন বাজার পরিস্থিতি বলছে, প্রতিটি ঈদ পোশাকের দাম সর্বনিম্ন ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চড়েছে। অর্থাৎ এক হাজার টাকা দামের একটা পোশাক কিনতে আগের তুলনায় ক্রেতাকে এখন ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। গত দুই বছর ধরে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তি। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ এবং ক্ষেত্র ও পণ্যভেদে তার চেয়ে বেশি চড়েছে। তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি তেল, সাবান, শ্যাম্পুর মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া বাসাভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ প্রতিটি খাতেই জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে অনেকের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা এসবের সামগ্রিক যোগফল বাজারে এখন দ্বিমুখী ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি তৈরি করেছে। দেশে বর্তমানে এই মূল্যস্ফীতির পারদ ৯ শতাংশের ওপরে ঘোরাফেরা করছে। এর অর্থ হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে জীবনধারণ ব্যয় ৯ শতাংশ হারে বাড়ল। এর ফলে আয় নির্দিষ্ট থাকায় ক্রয়ক্ষমতা অনুরূপহারে কমে গেল, যা দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের আয়ে বড় রকমের চিড় ধরিয়েছে। দরিদ্রশ্রেণির মানুষের তো আরও ভয়াবহ দশা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। অর্থাৎ উৎপাদন, চাহিদা, ঘাটতি, আমদানি কোন পর্যন্ত করতে হবে, কখন দরকার—এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারকরা কোথায় কখন কোন পণ্যের ঘাটতি হবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আবার বাজারে যে নজরদারি দরকার সেটা না থাকায় যেসব পণ্য উৎপাদক ও আমদানিকারক কম সেখানে দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখেনি বলেই দেশে মূল্যস্ফীতির আজকের পরিণতিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩’-এর চূড়ান্ত জরিপ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ পরিবার তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদবাজারে এখন তারই প্রভাব পড়েছে। উচ্চবিত্তরা এই ধাক্কা সামলাতেও পারলেও সমাজের সবচেয়ে বড় শ্রেণি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতারে যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি—যাদের আয় অপরিবর্তিত, কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে অনুরূপহারে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে; তাদেরই এখন ঈদবাজার কেনাকাটায় এই ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
ঈদের পোশাকের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন কালবেলাকে জানান, ‘যেহেতু এবার মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ এমনিতেই খারাপ অবস্থায় আছে, তার ওপর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এখনো বোনাস হয় নাই, তাই এবার ঈদ বিক্রির ভলিউম খুব বেশি বড় হবে না। তবে পোশাকের দাম নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। কারণ কম দামেরও আছে আবার বেশি দামেরও আছে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করবে। এখানে কোনো জোর নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা তো কারও পকেট থেকে জোর করে পণ্য নিচ্ছে না। তারা পণ্য দিয়েই দাম নিচ্ছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি। বাজারের এই অস্থিরতার জন্যে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দায়ী। এভাবে বিভিন্ন পণ্যে বাড়তি মূল্য দেওয়ার কারণেই মানুষের ব্যয় ধারণসীমার বাইরে চলে গেছে। এতে বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় ভোক্তা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সিন্ডিকেট ভেঙে ভোক্তাদের স্বস্তি নিশ্চিত করতে সরকারকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’
এদিকে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এখন বেচাকেনা খানিকটা বাড়লেও অন্যান্য বছরের ঈদের বাজার পরিস্থিতি যেমন জমজমাট থাকে এবার এখন পর্যন্ত তা দেখা যাচ্ছে না। যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সসহ রাজধানীর অন্যান্য শপিংমলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রেতার আনাগোনা কম। এর পরিবর্তে তুলনামূলক কম দামের নিউমার্কেট, মৌচাকসহ এই জাতীয় মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু এখানে এসেও পোশাকের দাম শুনে হতাশ ক্রেতারা। বাধ্য হয়ে অনেকে মার্কেট ছেড়ে নেমে আসছেন ফুটপাতে। যেখানে দরদাম করে সাধ্যের মধ্যে পরিবার ও স্বজনের মনোতুষ্টির জন্য চেষ্টা করছেন নতুন পোশাক কেনার। এতেও জমছে না বেচাকেনা। তার প্রমাণ মেলে মৌচাকের পাইকারি ব্যবসায়ী ইউনূছ আলীর কথায়। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘রোজায় আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রির টার্গেট থাকে। কিন্তু গতবারের তুলনায় এবার ২৫-৩০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে।’
আর খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের কেনাকাটা এখনো তেমন শুরু হয়নি। যারা আসছেন তারাও দেখে চলে যাচ্ছেন। তবে আগামী মাসের শুরুতে বেতন-বোনাস পাওয়ার পর কেনাকাটা বাড়বে—এমন প্রত্যাশা করেই বসে আছেন তারা।
গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে ছেলের জন্য পাঞ্জাবি পছন্দ করতে এসেছিলেন বাহাউদ্দিন নামের একজন ক্রেতা। তিনি বলেন, গতবছর আড়ং থেকে দুই ছেলেকে পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার জিনিসপত্রের মাত্রাতিরিক্ত দামে হাতে খুব বেশি টাকা নেই; কিন্তু ঈদে নতুন পাঞ্জাবি না দিলেও মনটা খারাপ হয়ে যাবে। তাই এবার এখান থেকেই কিনে দিচ্ছি।