মামলার ফাঁদে ২২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:৫১ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:২৯ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মামলার জটিলতায় হিমশিম অবস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের। যেখানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায়ের সবচেয়ে বেশি ৩৭ ভাগ এ বিভাগ থেকে আসার কথা, সেখানে মামলার জালেই আটকা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাঠপর্যায়ের ১২টি অফিসের অধীনে আট হাজার ৭৪৫টি মামলার বিপরীতে ওই টাকা দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী অবস্থায় আছে। এসব মামলার মধ্যে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় দুই হাজার ৫২১টি। যার সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ভ্যাট হিসেবে ভ্যাট বিভাগের পাওনা ১৭ হাজার ৩২৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আদালতের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে স্বল্প সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বা এডিআর কিংবা এনবিআরের অধীন কাস্টমস ও ভ্যাট সংক্রান্ত আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, কোনো কিছুই মামলার জট কমাতে পারছে না। এনবিআরের নানা উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের সাহায্য নিতেই যেন বেশি আগ্রহ। এনবিআরের পরিসংখ্যান সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের সর্বশেষ তথ্যানুসারে আট হাজার ৭৪৫টি ভ্যাট বা মূসক সংক্রান্ত মামলার বিপরীতে মোট ২১ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার রাজস্ব আটকে আছে। প্রতিষ্ঠানটির বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (মূসক) অধীনেই আটকে আছে ১৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। যেখানে অনিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ৬০১টি। অথচ এ অফিসের আওতায় সিগারেট, মুঠোফোন, ওষুধ, ব্যাংক, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিতরণ, কোমল পানীয়, সাবান, সিমেন্ট ও পানি সরবরাহের কোম্পানিগুলো ভ্যাট পরিশোধ করে থাকে। এর পরের অবস্থান ঢাকা দক্ষিণের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের। এ অফিসের আওতায় মোট মামলার সংখ্যা এক হাজার ৫৫৩টি। এসব মামলার বিপরীতে দুই হাজার ৭৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ভ্যাট অনাদায়ী রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্মাইজ ও ভ্যাট কমিশনারের আওতায় এক হাজার ১৮৬টি মামলা আওতায় আটকে আছে এক হাজার ৮৬১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ভ্যাট। ঢাকা পূর্ব কাস্টমস, এক্মাইজ ও ভ্যাট কমিশনারের আওতায় ৯২৬টি মামলার বিপরীতে ৯০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, অন্যদিকে ঢাকা পশ্চিমের কাস্টমস, এক্মাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতায় ৯২৩টি মামলার বিপরীতে ভ্যাট বকেয়া ৬২৩ কোটি চার লাখ টাকা।
অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাটি কমিশনারেটের অধীনে যথাক্রমে ২৮৮, ৫৩৫, ৫৬৫, ৬৮৩, ৮০৬, ৩৩৭ ও ৩৪২টি মামলায় আটকে আছে ৫১৬.৪৯, ৪৫৪.১৮, ২০৬.৯২, ১৯৩.১৫, ৬০৮ ও ৩৯.০৮ কোটি টাকা। মামলার জটের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য (ভ্যাট নিরীক্ষা) ড. মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, মামলার জট কমাতে এনবিআর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরের মাধ্যমে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মাঠপর্যায়ের অফিসগুলোকে। আগের চেয়ে মামলাও কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (মূসক) অধীনে ৬০১টি মামলার মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ মিলিয়ে ৪৯৭টি মামলা দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়েছে। যেখানে আটকে আছে ১২ হাজার ৮৪৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে মোট মামলার সংখ্যা এক হাজার ৫৫৩টি। এর মধ্যে ৫৭২টি মামলায় আটকে আছে এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর পরের অবস্থান হাইকোর্টে। এখানে ৫৬৫টি মামলায় আটকে রয়েছে ৬৯২ কোটি ১১ লাখ টাকার ভ্যাট।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের আওতায় এক হাজার ১৮৬টি মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সার্টিফিকেট মামলা। যার সংখ্যা ৬২৬টি। তবে, টাকার পরিমাণের দিক থেকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ মিলিয়ে ২০৩ মামলায় আটকে আছে এক হাজার ২৯৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ঢাকা পূর্ব ভ্যাট অফিসের আওতায় ৯২৬টি মামলার ফাঁদে আটকে রয়েছে ৯০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ অফিসের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে সর্বাধিক ৪২০টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে ৬৮২ কোটি ৫১ লাখ টাকার রাজস্ব। ঢাকা পশ্চিম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অধীনে মামলা জটিলতায় আটকে আছে ৬২৩ কোটি চার লাখ টাকা। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে অনিষ্পত্তি ১৭১টি মামলায় ৫৫৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা পড়ে আছে।
প্রসঙ্গত, গত অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি মামলায় প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আটকে থাকার তথ্য ছিল। নভেম্বর পেরিয়ে সেই সংখ্যা কিছুটা কমেছে। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি মাসিক সমন্বয় সভায় মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি মামলার নিষ্পত্তি অব্যাহত রাখতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। পাশাপাশি এডিআরকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরের নির্দেশনা দেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
আদালতের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে স্বল্প সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর বলা হয়। যেখানে করদাতার মামলার খরচ ও সময় দুটিই বাঁচে। সরকারও দ্রুত রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়। আপিল, ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এনবিআর মনোনীত একজন নিরপেক্ষ সহায়তাকারীর মধ্যস্থতায় করদাতা ও কর বিভাগের প্রতিনিধিদের মতৈক্যের ভিত্তিতে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চুক্তি হয়। এক্ষেত্রে মামলাটি যে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারাধীন, সেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এডিআর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। মামলা নিষ্পত্তির জন্য করদাতাকে বিরোধীয় করের ৫ শতাংশ (সর্বনিম্ন দুই হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা) ফি দিতে হয়। এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৯০ দিন। এক্ষেত্রে মতৈক্য না হলে করদাতা পুনরায় আদালতে ফিরে যেতে পারেন। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশের কর প্রশাসনে এ পদ্ধতি চালু হয়।